প্রত্যাবাসন বিলম্বে হতাশ হিন্দু রোহিঙ্গারা

কামরান রেজা চৌধুরী ও তুষার তুহিন
2018.01.25
কক্সবাজার
রাখাইনের মংডুর চিকনমারি থেকে আসা হিন্দু রোহিঙ্গা সুবাস রুদ্র। এখন তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন। রাখাইনের মংডুর চিকনমারি থেকে আসা হিন্দু রোহিঙ্গা সুবাস রুদ্র। এখন তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন। ২৫ জানুয়ারি ২০১৮।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিলম্বে হতাশ হয়ে পড়েছেন মিয়ানমার ফিরে যেতে আগ্রহী হিন্দু রোহিঙ্গারা। তাঁরা শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা চাচ্ছেন যে, রাখাইন ফিরে গেলে নতুন করে আক্রমণের শিকার হবেন না।

রাখাইন রাজ্যে গত আগস্টে শুরু হওয়া সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাত লাখ মুসলিম রোহিঙ্গার সাথে ৫ শ’র মতো হিন্দু শরণার্থীও রয়েছেন।

তাঁরা সবাই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের নাগরিক এবং কালো পোশাক পরা মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের আক্রমণে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে জানান।

“কালো পোশাক পরা মুখোশধারী কিছু লোক আগস্টের শেষের দিকে আমাদের গ্রামে হামলে পড়েছিল। তারা আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। আমরা পালিয়ে আসতে বাধ্য হই,” বেনারকে বলেন রাখাইনের চিকনমারি থেকে আসা শরণার্থী সুবাস রুদ্র।

শরণার্থী নিতাই শীল গত সেপ্টেম্বরে বেনারকে জানান, গ্রামে থাকলে মরতে হবে এমন খবর পেয়ে ১১২টি পরিবার বাংলাদেশে চলে আসে।

নিতাই বলেন, “সপ্তাহ খানেক সময় আমরা বাড়ি থেকে বের হতে পারছিলাম না। গ্রামের চারপাশ কালো কাপড় পরা লোকজন ঘিরে রেখেছিল।”

এরপরই তাঁরা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই কমপক্ষে ১২জন পুরুষ নিহত হন বলে বেনারকে জানিয়েছিলেন নিতাই শীল।

পরবর্তীতে হিন্দু রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়দের উদ্যোগে উখিয়ার কুতুপালং বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে একটি শিবির খোলা হয়।

“৪৩৯ রোহিঙ্গা হিন্দুকে উখিয়ার হিন্দু পাড়ায় একটি বিশেষ ক্যাম্পে জায়গা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য আমরা সেখানে একটি পুলিশ পোস্ট বসিয়েছি। নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা মুসলমানদের থেকে তাদের আলাদা রাখা হয়েছে,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারে অবস্থিত কমিশনার কার্যালয়ের উপসহকারী মো. শামসুদ্দোজা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দশজন হিন্দু রোহিঙ্গাকে গত সেপ্টেম্বরে অপহরণের ঘটনা ঘটে। হিন্দুরা এর জন্য মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকেই দায়ী করছেন।

অপহরণকারীরা নির্যাতনের পর আটজনকে ছেড়ে দেয়। বাকি দুজনের মধ্যে রবীন্দ্র পালের লাশ পরবর্তীতে পুলিশ উদ্ধার করে, তবে এখন পর্যন্ত নাদরা পালের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

“উখিয়ায় মুসলমান রোহিঙ্গারা রবীন্দ্র পাল নামে একজন হিন্দু রোহিঙ্গাকে মেরে ফেলেছে। রবীন্দ্র’র ভাই নদরা পাল এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছে,” বেনারকে বলেন সোনারাম পাল (৪৫)। তিনিও এসেছেন রাখাইনের চিকনমারি গ্রাম থেকে।

কক্সবাজারের উখিয়ায় হিন্দুপাড়া শরণার্থী শিবিরে নাতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক রোহিঙ্গা হিন্দু নারী। ২৫ জানুয়ারি ২০১৮।
কক্সবাজারের উখিয়ায় হিন্দুপাড়া শরণার্থী শিবিরে নাতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক রোহিঙ্গা হিন্দু নারী। ২৫ জানুয়ারি ২০১৮।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ

 

আমরা ফিরে যেতে চাই

বর্তমানে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আতঙ্কিত হবার মতো কিছু না থাকলেও এখানে অভাব অনটনের কারণে মিয়ানমার ফিরতে উদগ্রীব হয়ে আছেন হিন্দু শরণার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে সুবাস রুদ্র বেনারকে বলেন, “এখানে কোনো সন্ত্রাস হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের কোনো কাজের সুযোগ নেই। আমরা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারি না; রিলিফের মালের ওপর নির্ভর। প্রতিদিন শুধু ভাত আর ডাল, মাছ মাংস খেতে পাই না। এসব খেতে খেতে বিরক্তি এসে গেছে।”

“চিকনমারিতে আমি একজন অবস্থাপন্ন মানুষ ছিলাম। অথচ এখানে ছেঁড়া কাপড় পরে আছি,” বলেন তিনি।

আট সন্তানের জনক রুদ্র জানান, তার এক পুত্র ভারতে পালিয়ে গেছে। সন্ত্রাস শুরু হওয়ার পর দুই পুত্র এবং তিন কন্যাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁর দুই মেয়ে এখনো মিয়ানমারে রয়ে গছে বলে তিনি জানান।

“আশা করেছিলাম জানুয়ারির শেষের দিকে রাখাইন যেতে পারব। এখন কেউ বলতে পারছে না, কবে নাগাদ আমরা ফিরতে পারব। আমরা হতাশ,” তিনি বলেন।

চিকনমারি থেকে আসা সুনীল রুদ্রের স্ত্রী রত্না রুদ্র বেনারকে বলেন, “আমরা কেউ এখানে থাকতে চাই না। আমাদের আর নির্যাতন করবে না নিশ্চয়তা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ফিরে যেতে চাই।”

“বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আমাদের নিজ দেশে ফেরত নেন,” রত্না রুদ্র বলেন।

চিকনমারি গ্রামের ব্যবসায়ী সোনারাম পাল (৪৫) বেনারকে বলেন, “আমরা ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এনজিও কিংবা জাতিসংঘের কেউ বলতে পারছে না আমরা কবে ফিরতে পারব।”

বেনারনিউজের প্রতিনিধিরা হিন্দুপাড়া শরণার্থী শিবিরের পাশেই একটি পুলিশ ফাড়ি দেখেছেন। হিন্দু শরণার্থীদের রক্ষার জন্য সেখানে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার কর্মকর্তারা কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কার্যক্রম তদারকি করছেন।

“আমরা দিনরাত তাঁদের পাহারা দিচ্ছি,” একজন পুলিশ সদস্য বেনারকে জানান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।