নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের গণমাধ্যম: রোহিঙ্গা ভিশন টিভি
2018.01.31
কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া
পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো নিপীড়িত দেশহীন জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে রোহিঙ্গা ভিশন টিভি।
রোহিঙ্গাদের ইউটিউব-ভিত্তিক প্রায় অর্ধ ডজন টিভি চ্যানেলের মধ্যে অন্যতম এই রোহিঙ্গা ভিশন বা আরভিশন টিভি। বর্তমানে এই চ্যানেলটির দৈনিক দর্শক সংখ্যা প্রায় এক লাখ।
নির্বাসিত রোহিঙ্গা তরুণদের উদ্যোগে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এই টিভি চ্যানেলটি শুরু হয় ২০১২ সালে।
শুরুতে বিষয়টি ছিল “একটু একটু করে আগানো,” বেনারকে বলেন আরভিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মাদ নূর।
তবে ২০১২’র জুনে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা সংঘঠিত হবার পর নেটওয়ার্কটির কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা হয়।
ওই বছরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও গণহত্যায় রাখাইনের রাজধানি সিত্তে ও এর আশপাশে ২০০’র বেশি নিহত ও দেড় লাখের মতো মানুষ উদ্বাস্তু হয়, যাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা।
“আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এসে আমাদের ঘটনা জিজ্ঞেস করবে তার অপেক্ষায় আমরা বসে থাকতে পারি না। আমরা মনে করি, নিজেদের কথা বলার জন্য আমাদের নিজস্ব গণমাধ্যম প্রয়োজন,” বেনারকে বলেন নূর।
৩৬ বছর বয়স্ক নূর জানান, ২০১১ সাল থেকেই তাঁরা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও সংগ্রামের কথা বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য নিজস্ব একটি মাধ্যম খুঁজছিলেন। তখনই এইরকম একটি মাধ্যমের কথা তাঁদের মাথায় আসে।
তবে প্রথম দিকে তাঁরা একটি রেডিও স্টেশন স্থাপনের কথা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু রেডিও স্টেশনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনার ব্যাপকতা ও মিয়ানমার সরকার থেকে অনুমোদন না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে তাঁরা পরবর্তীতে ইউটিউব ভিত্তিক চ্যানেলের কথা ভাবতে শুরু করেন বলে জানান নূর।
এর বছরখানেক পরে ভিডিও এডিটং, ক্যামেরা চালানো ও অন্যান্য দক্ষতাসম্পন্ন রোহিঙ্গাদের সাথে তাঁদের যোগাযোগ তৈরি হয়। টিভির জন্য একটি লগোও চূড়ান্ত হয়।
“এভাবেই শুরু হলো, আমরা কিছু কম্পিউটার এবং অনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনার জন্য রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের কাছে প্রকল্পে অর্থায়নের আহ্বান জানালাম,” বলেন নূর।
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আরভিশন টিভি ইন্টারনেটে দেখা যায়। বার্মার সংবাদ জানার জন্য এটিই একমাত্র উপায়। আমরা এই চ্যানেলটিকে বিশ্বাস করি।”
“আরভিশনের মাধ্যমে আমরা মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের সংবাদ পাই। এটা আমাদের কাছে তথ্যের একটি ভালো উৎস,” বেনারকে বলেন উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা আনওয়ার সিদ্দিকী।
আরভিশনের সংবাদ সঠিক কি না কীভাবে যাচাই করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সংবাদের সঠিকত্ব যাচাইর জন্য আমরা আরাকানে আমাদের পরিচিতদের কাছে ফোন করি।”
“শিবিরে আমরা কোনো টিভি দেখতে পারি না। ফলে আমরা রোহিঙ্গাদের ঘটনা জানার জন্য ইউটিউবে আরভিশনের ওপর নির্ভর করি,” বলেন আনওয়ার।
আরভিশন কার্যক্রম: চার ভাষা, ছয় দেশ
রোহিঙ্গাদের নিজস্ব মালিকানার এই নেটওয়ার্কটি থেকে বর্তমানে ইংরেজি, আরবি, বার্মিজ ও রোহিঙ্গা; মোট চারটি ভাষায় সংবাদ প্রচারিত হয় বলে জানান মোহাম্মদ নূর।
রাখাইনের ভেতরে থেকে কাজ করা কয়েক ডজন প্রতিবেদকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় শ খানেক প্রতিবেদক রয়েছে চ্যানেলটির।
“আমরা আরভিশনকে নেটওয়ার্ক বলি, কারণ আমাদের রয়েছে তিনটা সংবাদমাধ্যম, অনলাইন টিভি, স্যাটেলাইট টিভি এবং অনলাইন ম্যাগাজিন,” বলেন নূর।
তাঁদের প্রতিবেদনগুলোর মুখ্য স্থানে রয়েছে রাখাইনের সংবাদ। যার মাধ্যমে তাঁরা রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওরপর মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাগুলোর গভীর বিশ্লেষণ ও তথ্য প্রচার করে থাকেন।
নূর বলেন, “গণমাধ্যমের পাশাপাশি, আমরা তথ্যপ্রমাণমূলক প্রতিবেদন তৈরির জন্য গণসংযোগের কাজও করে থাকি।”
“আমাদের গণসংযোগ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে তাঁদেরকে সঠিক তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করা, যাতে তাঁরা সেগুলো তাঁদের প্রতিবেদনে ব্যবহার করতে পারে,” বলেন নূর।
দর্শকদের বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনার সংবাদ দেবার পাশপাশি বিভিন্ন দেশে থাকা শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সংবাদ প্রচারও তাঁদের চ্যানেলর অন্যতম কার্যক্রম বলে জানান তিনি।
আরভিশনের প্রডাকশন সেন্টারটি কুয়ালালামপুরের টুইন টাওয়ার থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে জালান আমপাঙ-এ অবস্থিত। আর প্রধান কার্যালয় সৌদি আরব।
রাখাইন রাজ্যের ভেতরে আরভিশনের কোনো দপ্তর না থাকলেও বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ভেতর একটি অফিস রয়েছে বলে জানান নূর।
এছাড়া পাকিস্তান ও সাইপ্রাসে তাঁদের কার্যালয় রয়েছে।
তিনি জানান, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কর্মরত প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৩৫ জনের মতো।
রাখাইনে ছদ্মবেশী প্রতিবেদক
নূর বলেন, রাখাইনের ভেতরে কী ঘটছে তা প্রচার করা নিঃসন্দেহে “পার্কে হাঁটার মতো” সহজ ঘটনা নয়। বিশেষ করে মিয়ানমার সরকারের নজরদারির ভেতর, যাদের সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
তিনি বলেন, “এটা মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশের মতো নয়, যে তাঁরা গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে বলবেন- আমি আরভিশন প্রতিবেদক, আমি ওখানে যেতে চাই।”
রাখাইনের ভেতরে কাজ করা প্রতিবেদকরা সবাই গোপনে কাজ করেন, এমনকি নিজেরাও একে অন্যকে চেনেন না বলে জানান নূর।
তিনি বলেন, “তাঁদেরকে সেখানে সাংবাদিক হিসেবে কেউই চেনে না।”
“আরভিশনের পূর্ণকালীন প্রতিবেদকরা ঘটনাস্থলে যান না, তাঁরা এলাকার ঘটনার ওপর নীরবে ও গোপনে প্রতিবেদন করেন,” বেনারকে বলেন নূর।
কর্মীদের নিরাপত্তা, বিশেষত রাখাইনে কর্মরতদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কর্মীদের সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার বিষয়ে তারা খুব কঠোরতা অবলম্বন করেন বলে জানান নূর।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের অর্থায়নে আরভিশন পরিচালিত হয়। তবে বাড়তি তহবিলের জন্য তাঁরা এখন রোহিঙ্গাদের বাইরে থেকেও অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন বলে নূর জানান।
“এখনকার মতো আমাদের যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত করছি, ফলে আমাদের অবশ্যই আরো তহবিল প্রয়োজন,” বলেন তিনি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।