অর্থায়ন ঘাটতি, কমতে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা
2023.02.17
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে তীব্র অপুষ্টি থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে অর্থায়নে ঘাটতির কারণে মার্চে শরণার্থীদের খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ প্রায় ১৭ শতাংশ কমাতে হবে।
শুক্রবার সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই রেশন আগামী এপ্রিল থেকে আরো যাতে কমাতে না হয়, সেজন্য দাতাদের কাছে সাড়ে ১২ কোটি ডলারের জরুরি তহবিল চাওয়া হয়েছে।
রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এমন ঘোষণায় শরণার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে শরণার্থী শিবিরে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা এবং অপুষ্টিজনিত সংকট বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
“আমাদের জন্য প্রতি মাসে দুই ডলার কমিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে আমাদের জীবনযাত্রার ওপর খুব বাজে প্রভাব পড়বে। কারণ, বাইরে কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় দুঃখ-কষ্টে জীবন চালাতে হয়। এখন সেটি আরো তীব্র হবে,” শুক্রবার বেনারকে বলেন কক্সবাজার টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা নূর বশর।
এতে রোহিঙ্গাদের অভাব আরো বেড়ে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “লোকজন অভাবে থাকলে বিভিন্ন অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকবে।”
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে
বাজেট কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণের পরিমাণ কমেছে জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “এটির অবশ্যই প্রভাব রয়েছে।”
তিনি বলেন “খাদ্যের অভাব থাকলে রোহিঙ্গারা কাজের সুযোগ খুঁজতে ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া চেষ্টা করবে। ফলে এক ধরনের খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকবে। তাই আন্তর্জাতিক ডোনারদের দ্রুত এগিয়ে আসা উচিত।”
বর্তমানে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি থেকে রোহিঙ্গার প্রতিমাসে মাথাপিছু ১২ ডলার খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন।
এটিকে ‘অপ্রতুল’ হিসেবে উল্লেখ করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বেনারকে জানান, “এর মধ্যে রেশন আরো কমিয়ে দিলে রোহিঙ্গারা খাদ্যের অভাবে থাকবে। ফলে অভাব দূর করতে তারা বিভিন্ন অন্যায় কাজে লিপ্ত হবে। এতে ক্যাম্পের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।”
বর্তমানে বরাদ্দের ১২ ডলার থেকে খাদ্যসামগ্রী ছাড়াও জামাকাপড়সহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে রোহিঙ্গারা “হিমশিম খাচ্ছে” বলে বেনারকে জানান টেকনাফ লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।
এ অবস্থায় বরাদ্দ কমে গেলে “রোহিঙ্গাদের পাচার কিংবা সমুদ্র পথে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর।
সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের দুই বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য সহায়তার বরাদ্দ কমানো হলে তার বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ মাইকেল ফাখরি ও থমাস এন্ড্রু।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এক বিবৃতিতে এই দুই বিশেষজ্ঞ ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান দেওয়ার জন্য জরুরি আবেদন জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যদি অনুদান কাটছাঁট করা হয় তা অরক্ষিত লোকদের (রোহিঙ্গা শরণার্থী) ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, যারা ইতিমধ্যেই খাদ্যে অনিরাপদ। তারা অপুষ্টির উচ্চ মাত্রায় রয়েছে এবং এক তৃতীয়াংশেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু কম ওজনের।”
তারা বলেন, প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা কমিয়ে আনলে শরণার্থী শিবিরগুলিতে আরও সহিংসতা এবং অস্থিরতা বাড়াতে পারে। মানবপাচারের ঝুঁকি বাড়বে। আরো বেশি বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় আগ্রহ তৈরি করবে।
বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ওনো ভ্যান ম্যানেন দাতা সংস্থাগুলোর এমন অবস্থানকে অপ্রত্যাশিত হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশচুম্বী, রোহিঙ্গা শিশু এবং তাদের পরিবারগুলি ভগ্নদশা অবস্থায় রয়েছে এবং তাদের আরও সহায়তা প্রয়োজন। ….আমরা ক্ষুধা ও অপুষ্টির পাশাপাশি বাল্যবিবাহ এবং শিশু শ্রমের সংবাদ পাচ্ছি এমন সময়ে যখন বাবা-মায়ের কাজ করার প্রায় কোনো সুযোগ নেই, এবং পরিবারগুলো শরণার্থী শিবিরের বাইরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে।”
দাতা দেশগুলোর পিছিয়ে যাওয়াকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের পরিবারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের দুর্বলতা হিসেবেও দেখছেন তিনি।
অনুদান অপর্যাপ্ত: ডব্লিউএফপি
বেনারের ই-মেইলের জবাবে ডব্লিউএফপি’র কক্সবাজার কার্যালয় শুক্রবার জানিয়েছে, “অপর্যাপ্ত অনুদানের কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দেওয়া খাদ্য সহায়তার পরিমাণ কমাতে বাধ্য হলো ডব্লিউএফপি।”
এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকটের প্রায় ৬ বছরের মাথায় এই প্রথমবারের মতো ডব্লিউএফপি বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের জন্য দেওয়া জীবন রক্ষাকারী সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে।
১ মার্চ থেকে অনুদানের পরিমাণে ১২ কোটি ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার কম থাকার কারণে জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে (ডব্লিউএফপি) প্রত্যেক রোহিঙ্গার জন্য দেওয়া খাদ্য সহায়তা ভাউচারের পরিমাণ ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে ১০ মার্কিন ডলারে নিয়ে আসতে হয়েছে।
বাংলাদেশে ডব্লিউএফপি’র কান্ট্রি ডিরেক্টর ডম স্কালপেল্লি বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও মানবিক সহায়তা দানকারী গোষ্ঠীর জন্য এটি একটি বড়ো ধরনের বিপর্যয়।”
অন্যান্য অতি জরুরি সেবাগুলো সংকুচিত হয়ে আসার সাথে সাথে খাদ্য সহায়তায় এই পরিবর্তনের প্রভাব হবে “মারাত্মক” বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। রোহিঙ্গারা তাঁদের খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে মানবিক সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।
মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলোর সমবেত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে পারে না, যার ফলে ক্যাম্পগুলোতে ব্যাপকভাবে অপুষ্টি লক্ষণীয়।
শিবিরে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো শিশুর সঠিক শারীরিক বিকাশ ও বৃদ্ধি হয় না, আর গর্ভবতী ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন — এমন নারীদের ৪০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
“প্রতিবার খাদ্য সহায়তা হ্রাসের সাথে সাথে অনিবার্যভাবে অপুষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়বে নারী, কিশোরী ও শিশুদের ওপর,” বলেন স্কালপেল্লি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। সব মিলিয়ে এখন ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছেন।
রোহিঙ্গাদের ভাউচারের মাধ্যমে প্রতিমাসে জনপ্রতি ১২ মার্কিন ডলার সমমূল্যের খাদ্য সহায়তা দেয়ায় হয়, যা ব্যবহার করে তাঁরা শরণার্থী শিবিরের ডব্লিউএফপি’র আউটলেটগুলো থেকে ৪০টিরও বেশি শুকনো ও তরতাজা খাবারের মধ্যে পছন্দের খাবারগুলো বেছে নিতে পারেন।