রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী এএমএম নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে ভারত

রোহিত ওয়াধওয়ানি
2018.02.21
নয়াদিল্লি
ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি রোহিঙ্গা শিবির। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭। ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি রোহিঙ্গা শিবির। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
AFP

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জঙ্গিদের সাথে সম্পৃক্ত একটি অখ্যাত রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সক্রিয় রয়েছে কিনা তার তদন্ত করা হচ্ছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।

বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের ওপর বোমা হামলার অভিযোগে বিহার থেকে গত মাসে জামাআতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) দুই সন্দেহভাজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে আকামুল মুজাহিদীন (এএমএম) নামের একটি রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীটির সন্ধান মেলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “এএমএম এর কোনো উপস্থিতি ভারতে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

“এদের কিছু সদস্যের উপস্থিতি আমাদের মিয়ানমার ও ভারতীয় সীমান্তে থাকতে পারে বলে আমরা সন্দেহ করছি। এরা ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে পারে,” বলেন তিনি।

গত ১৯ জানুয়ারি বুদ্ধগয়ায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বার্ষিক কালচক্র অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা তখন ওই এলাকায় অবস্থান করছিলেন। বিস্ফোরকের মাত্রা কম হওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ বলছে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সহিংসতার প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা করা হয়েছিল।

এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া দুই জেএমবি সদস্য বোমা হামলার সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পরই এএমএম এর বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে এনআই।

চলতি মাসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেপ্তার হয় দুই সন্দেহভাজন নব্য জেএমবি সদস্য। সেখানকার একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “উত্তর পূর্বাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘মাথাব্যথার’ কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এএমএম।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এই প্রথম আমরা জঙ্গিগোষ্ঠীটির নাম শুনছি। রোহিঙ্গাদের জন্য লড়াই করতে তাঁরা হয়ত এরই মধ্যে সদস্য সংগ্রহও শুরু করে দিয়েছে।”

এনআইএ এর ওই কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব ভিত্তিক জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি কমিটি এএমএম’র নেতৃত্বে রয়েছে। বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি এবং পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) এবং লস্কর ই তাইয়্যেবার (এলইটি) সঙ্গে এই গ্রুপটির যোগাযোগ রয়েছে।

তাঁর ভাষ্যমতে, এএমএম এর অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা পাকিস্তানে অবস্থান করছেন।

ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে জাতীয় সরকারের উদ্যোগের মধ্যেই দেশটির শীর্ষ জঙ্গিবাদ প্রতিরোধকারী সংস্থা এনআইএ এই তদন্ত শুরু করল। অন্যদিকে শুধু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ।

এদিকে বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে নিজ সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর নির্দেশনা চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। রোহিঙ্গাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে এই নির্দেশনা চেয়েছে তারা।

এএমএম নেতাদের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে অবস্থান

২০০৬ সালের অক্টোবরে রাখাইনের পুলিশ পোস্টে আক্রমণের জন্য এএমএম এবং আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশেন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়। এর পর পরই দেশটির সামরিক বাহিনীর অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান নেয়।

ওই সব হামলার পর মিয়ানমার সরকার বিবৃতি দিয়ে দাবি করে, তরুণদের প্ররোচিত করতে তারা ধর্মীয় চরমপন্থার আশ্রয় নেয়। এবং তাদের বাইরে থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। দশ মাস পরে নেপিদো আবারও হামলার জন্য আরসাকে দায়ী করে, যার ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ সামরিক অভিযানে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান নেয়।

২০১৬ সালে মিয়ানমার সরকার বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছিল, হাফিজ তোহার নামে এক রোহিঙ্গা এএমএমএর নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বসবাস করতেন। পাকিস্তানে থাকাকালীন তিনি তালেবানদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সাথে (আরএসও) এএমএমএর যোগসাজশ রয়েছে দাবি করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “তারা আইএস, তালিবান ও আল-কায়েদার মতো ইন্টারনেটে তাদের ভিডিওচিত্র সম্প্রচার করে।”

পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাত-উল-জিহাদ ইসলামি আরাকানের (হুজি-এ) প্রধান আব্দুস কাদোস বর্মি ৪৫ বছর বয়সী তোহারকে জঙ্গিবাদে নিয়ে আসেন। আর রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত এক পাকিস্তানি সেখানে তোহারের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর থেকে উঠে আসা তোহার সংগঠনের কমান্ডারদের একজন বলে জানান তিনি।

বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে অনুরণন

যদিও ভারতে জঙ্গি কার্যক্রমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংশ্লিষ্টতা খুব কমই পাওয়া গেছে তবুও এএমএম এর মতো একটি গ্রুপের বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করেন একজন স্থানীয় বিশ্লেষক ।

আসামের সাবেক জ্যেষ্ঠ পুলিশ সদস্য এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক জি এম শ্রিবাস্তব বেনারকে বলেন, “নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এএমএম ক্যাডাররা ভারতের বাংলা ভাষাভাষী এলাকার মৌলবাদীদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা চালাবে। এই পর্যায়ে, বিষয়টি ভারতের জন্য তেমন মাথাব্যথার কারণ নয়। তবে যেকোনো সতর্কবার্তা উপেক্ষা করলে এটা পরে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমাদের গোয়েন্দা সূত্র এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে গ্রুপটির কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করতে হবে এবং এদের যেকোনো ধরনের কর্মকাণ্ড একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের মাটি থেকে মুছে ফেলতে হবে।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল এবং গুয়াহাটি থেকে ঝুমুর দেব।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।