রাখাইনের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উপযোগী নয়: জাতিসংঘ
2023.03.20
ঢাকা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার প্রতিনিধিদল যখন বাংলাদেশে শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তখন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য উপযোগী নয়।
গত রোববার থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অবস্থিত ইউএনএইচসিআরের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর বলেছে, রাখাইনের পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর এই অবস্থান জানাচ্ছে সংস্থাটি।
পরীক্ষামূলকভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করার লক্ষ্যে বর্তমানে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিদর্শন করছে।
অভিযোগ উঠেছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের চলমান বাংলাদেশ সফরের জন্য জাতিসংঘ থেকে নৌকা সরবরাহ করা হয়েছে।
এমনকি নৌকাগুলো থেকে জাতিসংঘের প্রতীকও মুছে ফেলা হয়েছিল বলে মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর একটি ই-মেইল বার্তা থেকে জানা গেছে।
মিয়ানমার কর্মকর্তাদের বুধবার বাংলাদেশের কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘের নৌকা ব্যবহার করা হয়েছিল।
এই ঘটনার একদিন পর লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘মিয়ানমার অ্যাকাউন্টিবিলিটি প্রজেক্ট’ বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) সঙ্গে একটি ই-মেইল শেয়ার করে যেখানে দেখা যায়, মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রামানাথন ই-মেইল বৃহস্পতিবার পাঠানো ইমেইলে বলা হয়েছে, এ ধরনের কাজ মানবিক সহায়তা কর্মীদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
মূলত এই ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশস্থ ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তাদের বক্তব্য চেয়ে ই-মেইল পাঠানোর পর বাংলাদেশে অফিস বেনারের ইমেইলটি ইউএনএইচসিআরের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দপ্তরে পাঠায়।
তার প্রেক্ষিতেই রবিবার বিবৃতি দিয়ে ইউএনএইসিআর জানায়, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে ইউএনএইচসিআর অবগত কিন্তু দ্বিপক্ষীয় এই পাইলট প্রকল্পের কোনো আলোচনাতে তারা সম্পৃক্ত নয়।
ইউএনএইচসিআরের অবস্থান অপরিবর্তিত
বিবৃতিতে বলা হয়, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ইউএনএইচসিআরের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতিটি রোহিঙ্গার পছন্দের ভিত্তিতে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে, তবে কোনো শরণার্থীকে তা করতে বাধ্য করা উচিত নয়।”
বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে স্বেচ্ছায় এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে আসছে।
নিরাপদে প্রত্যাবাসনের অধিকার সংরক্ষণের জন্য, প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে সকল পক্ষের সংলাপ ও আলোচনার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত বলে মনে করে ইউএনএইচসিআর।
“এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ অনেক শরণার্থী পরিস্থিতি অনুকূল হলেই মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়,” বলা হয় বিবৃতিতে।
এতে বলা হয়, ২০১৭ সালের আগস্টের রোহিঙ্গার নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর থেকেই জাতিসংঘ মিয়ানমারকে উদ্বুদ্ধ করছে যাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাসগৃহ চিহ্নিত করা হয়, যা দেশে ফেরার পর প্রয়োজন হবে।
যেহেতু ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে সে কারণেই সম্প্রতি মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের প্রযুক্তিগত যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
“ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার প্রায় ১০ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করেন। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ ২০১৭’র আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া সামরিক দমন অভিযানের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন।
এদের মধ্য থেকে হাজারখানেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে সফররত প্রতিনিধিদল গত বুধবার থেকে এ পর্যন্ত ১৫৪ পরিবারের ৪৭৫ জন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনার খালিদ হোসেন।
মিয়ানমারের এই প্রতিনিধি দল দুই একদিনের মধ্যে দেশে ফিরবে।

ইউএনএইচসিআরের ভূমিকায় সন্দেহে রোহিঙ্গারা
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “সত্য কথা হচ্ছে… ইউএন সন্দেহের বাহিরে নয়। কারণ এর আগে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময়ে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সে কারণে আমাদের বারবার শরণার্থী হতে হচ্ছে। আমরা আর শরণার্থী হতে চাই না। তাই আমাদের প্রত্যাশা অন্তত ইউএন এবারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ওআইসিসহ রোহিঙ্গা কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করবে।”
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপাক্ষিক আয়োজনে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফিরে যান। কিন্তু রাখাইনের অবস্থা অনুকূল না হওয়ায় তাঁদের অনেকেই আবার পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন।
“ইউএন যদি বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কোনো দেশের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করে তবে আমরা অসহায় হয়ে পড়ব। আমরা আশা করবো ইউএন রোহিঙ্গাদের প্রতি সম্মান দেখাবে,” বলেন জোবায়ের।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, “মিয়ানমারে অভিযানের মুখে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেই, সেজন্য বাংলাদেশেকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমরা এখানে খুব বেশি ভালো আছি তা নয়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে নিজ দেশে (মিয়ানমারে) ফিরে যাওয়া। যাতে আবার শরণার্থী হয়ে ফিরতে না হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের মূল ভরসার জায়গা হচ্ছে ইউএন।”
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।