রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন: সরকারি মতে কাঁটাতারের বেড়া উদ্ধার কাজ ব্যাহত করেনি
2021.03.24
কক্সবাজার ও ঢাকা
কাঁটাতারের বেড়ার কারণে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের সময় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অভিযোগ বুধবার অস্বীকার করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
সরকারি তথ্যমতে, সোমবার বিকেল শুরু হওয়া দীর্ঘ আট ঘণ্টার ওই আগুনে মারা গেছেন ১১ জন। শরণার্থী শিবিরে সবচেয়ে বড়ো ওই আগুনে পুড়ে গেছে নয় হাজারের বেশি ঘর, বাসস্থান হারিয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার শরণার্থী।
শিবিরের চারপাশে কাঁটাতার বেড়া থাকার কারণে আগুনের সময় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয় বলে অভিযোগ জানায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, ওই অভিযোগ ঠিক নয়।
“আসলে কাঁটাতারের বেড়ার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বক্তব্য ঠিক নয়,” বুধবার বেনারকে বলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. সামছু দ্দৌজা নয়ন।
“মূলত বাতাসের গতি বেশি হওয়ার কারণে আগুনে নেভাতে সময় লেগেছে। তাছাড়া ক্যাম্প ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে,” যোগ করেন তিনি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা, সব মিলিয়ে এই সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ।
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আশেপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে সরকার।
জাতিসংঘ, মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, সোমবারের অগ্নিকাণ্ডের সময় কাঁটাতারের বেড়াগুলো উদ্ধার কাজ বাধাগ্রস্ত করেছে, ফলে ক্ষয়ক্ষতিও বেড়েছে।
“কাঁটাতারের বেড়া থাকায়, উদ্ধার কার্যক্রম কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে শরণার্থীরা নিজেরাই আগুন থেকে বাঁচতে বেড়া কেটে ফেলেছেন,” মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত সহায়তা সংগঠনগুলোর সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।
কাঁটাতারের বেড়ার কারণে উদ্ধার কাজে অংশ নিতে পারেননি বলে বুধবার বেনারকে জানান মো. শাহ আলম নামে একজন রোহিঙ্গা। তিনি পার্শ্ববর্তী ১৯ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা।
শাহ আলম বলেন, “৮ নম্বর ক্যাম্পে আগুন দেখার সাথে সাথে দৌড়ে সেখানে গিয়ে উদ্ধার কাজে যুক্ত হয়ে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ার জন্য তা পারিনি।”
“যদি কাঁটাতারের বেড়া না থাকত, হয়তো প্রাণহানি বা ক্ষতি কম হতো,” বলেন শাহ আলম।
নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক
সোমবারের অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা এগারো জনের বেশি নয় বলে বুধবার বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।
এর আগে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের শরণার্থী–বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ওই অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়।
“আমরা সব কিছু নিশ্চিত হয়ে বলছি, নিহতের সংখ্যা ১১ জনের বেশি নয়। এখন তারাও (ইউএনএইচসিআর) এটা স্বীকার করছে,” বুধবার বেনারকে বলেন শরণার্থী কমিশনার।
তবে বুধবার বেসরকারি সহায়তা সংস্থা ব্র্যাক জানায়, সোমবারের অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এদের তিনজন পুরুষ, চারজন নারী ও ছয়জন শিশু। এছাড়া ওই আগুনে আহত হয়েছেন ৫৬৩ জন।
এদিকে সরকারি হিসেবে আগুনে ১১ জন নিহত হবার তথ্য সম্পর্কে “অবগত” আছেন জানিয়ে ইউএনএইচসিআর-এর কমিউনিকেশন অফিসার লুইস ডোনোভান বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।”
অগ্নিকাণ্ডের পর এখন পর্যন্ত ৩৩৯ জনের সন্ধান মেলেনি বলেও উল্লেখ করেন লুইস ডোনোভান। তবে শরণার্থী কমিশনারের মতে, কেউ নিখোঁজ নেই।
“নিখোঁজ বলতে কিছু নেই। আগুন লাগার পরপরেই রোহিঙ্গারা আশেপাশের ক্যাম্পে স্বজনদের কাছে, লার্নিং সেন্টার, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল থেকেই কিন্তু তারা ফেরত আসতে শুরু করেছে,” বলেন শাহ রেজওয়ান হায়াত।
ক্ষতিগ্রস্তরা চাইলে ভাসানচরে যেতে পারবেন
বুধবার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যদি ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের কেউ ভাসানচরে যেতে চান, আমরা তাঁদের স্বাগত জানাব।”
“ভাসানচর তাঁদের জন্য অনেক সুন্দর ব্যবস্থা প্রস্তুত রয়েছে,” জানিয়ে মন্ত্রী বলেন “আমরা সব সময় বলছি, জোর করে কাউকে ভাসানচরে নেব না।”
“মূলত যারা ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন তাঁদের ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি।
এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডটি দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু সে বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনায় যদি কেউ জড়িত থাকে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “শুধু রোহিঙ্গা না স্থানীয়দেরও ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করছি খুব শিগগির এই ক্ষতি পুষিয়ে সংশ্লিষ্টরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।”
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্বের সম্প্রদায়ের সহায়তা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মিয়ানমারে তাঁদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আমরা আবেদন রাখছি।”
এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে গঠিত আটজনের তদন্ত কমিটির প্রধান শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, “আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার।”
নিঃস্ব রোহিঙ্গাদের আহাজারি
সরেজমিনে বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও শেষ সম্বল খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া স্থানে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাচ্ছেন কেউ কেউ। পোড়া ছাই মাটির সামনে বসে আহাজারি করছিলেন অনেকে। রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরেরা ব্যস্ত পুড়ে যাওয়া দোকানের ধ্বংসাবশেষ থেকে খাবার সংগ্রহ করতে।
উখিয়ার বালুখালী ৯-এর বি ব্লকের বাসিন্দা নূর নাহার (৫৫) বেনারকে বলেন, আগুনে সব হারিয়েছেন।
তিনি বলেন, “সকালে এনজিও লোকজন এসে নাম লিখে গেছে। অন্য একটি দল এসে একটি বিস্কুটের বক্স দিয়ে গেছে। সেগুলো খেয়ে দিন পার করছি।”
“এখানে পানি নেই। টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। কষ্টের দিন যেন ফুরাচ্ছে না,” বলেন নূর নাহার।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল তৈরি করে দেওয়ার কাজ চলছে বলে জানান শরণার্থী কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।
ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে টাকা ও ত্রাণ দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।