ভাসানচরে ত্রাণের ঘাটতি: রেডক্রসের প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারের ভিন্নমত
2021.03.30
ঢাকা ও কক্সবাজার
ভাসানচরে বর্তমানে থাকা ১৪ হাজার রোহিঙ্গার খাদ্যসহ মানবিক সহায়তায় আরো ত্রাণ প্রয়োজন জানিয়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্টের আহ্বানের পরদিনই নতুন করে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গাকে ওই দ্বীপে স্থানান্তর শুরু করেছে সরকার।
মঙ্গল ও বুধবার উখিয়া থেকে চট্টগ্রাম হয়ে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে এসব রোহিঙ্গাকে নেয়া হবে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত।
গত ২২ মার্চ উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে ভয়াবহ আগুনের পর এটিই প্রথম রোহিঙ্গা স্থানান্তর।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে এর আগে পাঁচ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় ১৪ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়।
শরণার্থীরা বলছেন, এবারে যাঁরা ভাসানচর যাচ্ছেন তাঁদের অনেকেরই বাড়িঘর আগুনে পুড়ে গেছে। এ ছাড়া, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও তাঁরা ভাসানচর যাচ্ছেন।
‘নারী-শিশুদের নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন’
ভাসানচর দ্বীপটি বসবাসযোগ্য কি না তা জানতে ১৩ থেকে ১৫ মার্চ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন রেডক্রস অ্যান্ড রেডক্রিসেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেড ক্রস এবং অন্যান্য সহযোগীদের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ১৩ থেকে ১৫ মার্চ ভাসানচর সফর করে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজের যোগাযোগ কর্মকর্তা সাজিদ হাসান।
সফরের প্রায় দুই সপ্তাহ পরে সোমবার এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভাসানচরে অবকাঠামোগতভাবে অগ্রগতি হয়েছে। তবে, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দিতে, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং বিদ্যালয় স্থাপনে জরুরিভাবে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট বাংলাদেশ শাখার প্রধান সঞ্জীব কাফলি বিবৃতিতে জানান, সাইক্লোন মৌসুম আসন্ন। কোনো বড় দুর্যোগ হলে রোহিঙ্গারা খাদ্যবিহীন অবস্থায় ভাসানচরে আটকে থাকবে। কারণ সেসময় সাগরে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ভাসানচরে যাঁরা অবস্থান করছেন তাঁরা নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে বসবাস করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের জীবিকাসহ জীবনযাপনের নতুন সুযোগ দিতে হবে। সেখানে শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা থাকতে হবে।
যোগাযোগ কর্মকর্তা সাজিদ হাসান জানান, “এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ভাসানচরের তৃণমূল পর্যায়ের বাস্তবতা সম্পর্কে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং এর অংশীদারদের বাস্তব ধারণা দেয়া।”
“এর মধ্যে রয়েছে ভাসানচরে আসা-যাওয়ার সুবিধা, সুরক্ষা ব্যবস্থা, সেখানকার বিদ্যমান অবকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সামাজিক সমস্যা ও জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ সুবিধা,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট এর ভাসানচর পরিদর্শনের আগে গণমাধ্যমে কোনো সংবাদ জানানো হয়নি। প্রতিনিধিদল এখনও তাদের পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানান সাজিদ হাসান।
এছাড়া মার্চের ১৭ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত ভাসানচর পরিদর্শন করে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল। তবে এখন পর্যন্ত সেই পরিদর্শনের কোনো প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়নি।
‘ভালো আছেন রোহিঙ্গারা’
রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্টের এই পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে শরণার্থী কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “তাঁরা যা বলছেন, সব ঠিক নয়। ভাসানচরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্ত। নারী ও শিশুরা নিরাপদে আছেন।”
তিনি বলেন, “ভাসানচরে দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে খাদ্যসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।”
“আমরা রোহিঙ্গা নারীদের একশ সেলাই মেশিন সরবরাহ করেছি, আরও মেশিন দেয়া হচ্ছে। সেগুলো দিয়ে তারা টেইলরিংয়ের কাজ শিখে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে,” বলেন শরণার্থী কমিশনার।
তিনি বলেন, “এ ছাড়া, গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ, মুরগির খামারসহ বিভিন্ন পেশার জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। দেয়া হয়েছে হাঁস-মুরগিসহ গবাদি পশু। বাগান করার কাজ তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন। সুতরাং, ভাসানচরে রোহিঙ্গারা ভালো আছেন।”
ষষ্ঠ দফা রোহিঙ্গা স্থানান্তর
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী শিবিরে ভয়াবহ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে আরো চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ নোয়াখালীর ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার প্রায় আড়াই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে উখিয়া থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন অতিরিক্ত আরআরআরসি মো. শামসু দ্দৌজা নয়ন।
একইভাবে বুধবার আরও দুই হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হবে বলে তিনি জানান।
সেখান থেকে বুধবার এসব রোহিঙ্গাকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নোয়াখালীর ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হবে।
বর্তমানে ভাসানচরে রয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
এদের মধ্যে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় এক হাজার ৬৪২ জন, ২৯ ডিসেম্বর এক হাজার ৮০৪ জন, চলতি বছরের ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় দফার তিন হাজার ২৪২ জন, ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ দফায় তিন হাজার ১৮ জন ও পঞ্চম দফায় ৩ ও ৪ মার্চ চার হাজার ২১ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচর স্থানান্তর করা হয়।
এ ছাড়া অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিনশ ছয় জন রোহিঙ্গাকে গত বছর মে মাসে ভাসানচরে নিয়ে যায় সরকার। তাঁরাও সেখানে রয়েছেন।
এর বাইরে দ্বীপে বেশ কিছু শিশুর জন্ম হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
‘নিরাপত্তার কথা ভেবে যাচ্ছি’
ষষ্ঠ দফায় ভাসানচরগামীদের মধ্যে ভয়াবহ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বালুখালীর শিবিরগুলো থেকে ১৭০টির বেশি পরিবার যাচ্ছে জানিয়ে শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “তারা স্বেচ্ছায় ভাসানচর যাচ্ছে।”
উখিয়ার বালুখালীর আট নম্বর শিবিরে বসবাস করতেন রমজান আলী (৩৭)। ২২ মার্চ ভয়াবহ আগুনে তাঁর বসতি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রমজানও রয়েছেন ষষ্ঠ দফায় ভাসানচর যাওয়ার দলে।
রমজান বেনারকে বলেন, “আমাকে জোর করে নেওয়া হচ্ছে না। পরিবারের ১৪ সদস্যকে নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাসানচর যাচ্ছি।”
“যারা আগে ভাসানচর গেছে, তাদের কাছে শুনেছি, ভাসানচর সুন্দর, সুযোগ–সুবিধা এখানকার চেয়ে অনেক ভালো। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বলেন রমজান।
বাড়ি-ঘর আগুনে পোড়ার আগেই ভাসানচর যাওয়ার জন্য তালিকায় নাম দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
একই এলাকার মৌলভী নুরুল আমিন বলেন, “এই জায়গার প্রতি মায়া জমে গেছে। কিন্তু এখানে (উখিয়ায়) এখন মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তার কথা ভেবে চলে যাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “তা ছাড়া বাড়ি-ঘরও পুড়ে গেছে। ভাসানচর গেলে ভালোভাবে থাকতে পারব। তাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের হিসাব মতে, ২২ মার্চ সংঘঠিত কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী এলাকায় এ যাবতকালে সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডে সেখানকার পাঁচটি রোহিঙ্গা শিবিরের নয় হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়।
এতে বাসস্থান হারান প্রায় ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা, পুড়ে মারা যান ১১জন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পর থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
এছাড়া নতুন-পুরনো মিলে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
শরণার্থীদের চাপ কমাতে দুই বছর আগে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী।