অনিরাপদ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান

আহম্মদ ফয়েজ ও আব্দুর রহমান
2023.03.31
ঢাকা ও কক্সবাজার
অনিরাপদ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান কক্সবাজার উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী শিবিরের একটি অংশে আগুন ধরে যাবার পর দূর থেকে তা দেখছেন অন্য শরণার্থীরা। ৫ মার্চ ২০২৩।
[এপি]

বাংলাদেশি কর্মকর্তারা অনেক রোহিঙ্গাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের মুখোমুখি করেছেন বলে এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)।

যদিও এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।

শুক্রবার এক বিবৃতিতে প্রত্যাবাসনের জন্য এখনো অনিরাপদ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের না পাঠাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডাব্লিউ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই সংস্থাটি জানায়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠালে সেখানে তাঁদের জীবন ও স্বাধীনতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

“মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সারা দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং রাখাইন রাজ্য চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই রকম অবস্থায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়,” বিবৃতিতে  বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী।

সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে এসে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে।

বিবৃতিতে এইচআরডাব্লিউ জানায়, সাক্ষাৎকার দেয়ার ক্ষেত্রে শরণার্থীদের হয় প্রতারিত করা হয়েছে, না হয় বাধ্য করা হয়েছে।

প্রতিনিধিদলের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া কয়েকজন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগের সঙ্গে তাঁদের বক্তব্যের মিল পাওয়া গেছে। যদিও এর আগে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়া রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ আসেনি।

বৈঠকের বিষয়বস্তু হিসেবে কয়েকজন শরণার্থীকে বলা হয়েছে, তৃতীয় দেশে সম্ভাব্য পুনর্বাসন সংক্রান্ত বৈঠক, উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, “জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করানোর জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের জন্য মোটেও উচিত হবে না। রোহিঙ্গারা তখনই নিরাপদে ফিরে যেতে পারবে যখন তাদের যথাযথ ও সম্মানজনক আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, শরণার্থীদের ফিরে যেতে বাধ্য না করে বাংলাদেশ সঠিক কাজ করেছে এবং দেশটির উচিত হবে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তায় সেই নীতি অব্যাহত রাখা।

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ১৭ কর্মকর্তার একটি প্রতিনিধিদল গত ১৫ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে।

বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের ওই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে অবস্থানকালে ৪৮০ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে।

প্রতিনিধি দলটি দেশে ফেরার পরে বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে জান্তা সরকারের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলেছে, পরীক্ষামূলক এই প্রত্যাবাসন এপ্রিলের মাঝামাঝিতে শুরু হতে পারে।

তবে প্রতিনিধি দল দেশে ফেরার পর বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়কে এই বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি।

মিজান বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত একটি পত্রের মাধ্যমে প্রতিনিধিদলকে সহযোগিতা করায় আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে তাঁদের পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো ধারণা আমরা এখনো পাইনি।”

রোহিঙ্গাদের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবৃতিতে দাবি করেছে, যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়েছেন এমন ১৫ রোহিঙ্গার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে।

“সবাই বলেছেন, মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জান্তা সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তাঁরা কেউ অবগত ছিলেন না,” বলা হয় বিবৃতিতে।

“রোহিঙ্গারা বলেছেন যে, গত দুই বছরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাঁদের বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎকার নিয়েছে কিন্তু তাঁদের নাম সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে—এমন তথ্য জানানো হয়নি,” উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

“আমাকে জানানো হয়নি যে, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল আমার সাক্ষাৎকার নেবে,” এক রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছে। গত ১৫ মার্চ পরিবারের ১০ জন সদস্যসহ মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। যাদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তাঁদের কারো পরিচয় প্রকাশ করেনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

“আমাকে ক্যাম্প ইনচার্জ আগেই ডেকেছিলেন এবং সাক্ষাৎকারের তারিখে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন। কী কারণে উপস্থিত থাকতে বলা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুনর্বাসনের জন্য বিদেশে পাঠানোর জন্য আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। আমি বুঝতে পারিনি মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমি দেখা করতে যাচ্ছি বা এটি প্রত্যাবাসনের বিষয়ে,” বলেন ওই শরণার্থী।

তিনি বলেন, অনুপস্থিত থাকলে পুলিশ দিয়ে হাজির হতে বাধ্য করা হবে এমন হুমকিও শরণার্থীদের দেওয়া হয়েছে, বলেন তিনি।

তবে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন মিজান। তিনি বলেন, “এসব বানোয়াট অভিযোগের কারণে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অনেক ভালো কাজও মানুষ বিশ্বাস করে না। কোনো শরণার্থীকে চাপ প্রয়োগ করা বা মিথ্যা বলার প্রশ্নই আসে না।”

বলা হয়েছিল ‘বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি প্রকাশের পর কয়েকজন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে বেনার।

পরিবারের চার সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের কাছে গত ১৮ মার্চ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের মোহাম্মদ আলম।

আলম বেনারকে বলেন, “গত ১০ মার্চ ক্যাম্পের মাঝির মাধ্যমে আমার পরিবারকে ডেকে নিয়ে যান ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি)। এরপর ‘ভাগ্য ভালো’ উল্লেখ করে আমাদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া হতে পারে বলে জানানো হয়। তবে কোন দেশে নিয়ে যাওয়া হবে সেটি জানানো হয়নি।”

তিনি বলেন, “বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একটি প্রতিনিধিদল আসবে, তাদের সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর আমরা ওই দিন টেকনাফ স্থলবন্দরে গিয়ে প্রতিনিধিদলের কাছে সাক্ষাৎকার দেই।”

মরিয়াম খাতুন নামে আরেক নারী শরণার্থী বলেন, “বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের কাছে আমাদের নেওয়া হয়েছে। আগে থেকেই মাঝিরা আমাদের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আসছিল। আর এখন বুঝতে পারছি মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার কথা চলছে।”

তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চান জানিয়ে এই শরণার্থী বলেন, “এভাবে যেতে চাই না। এমনভাবে ফিরতে চাই, যাতে করে আর পালাতে না হয়।”

টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা নুর বাশার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা আর শরণার্থী হিসেবে থাকতে চায় না। তাঁরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়। তবে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁরা ফিরতে চায় না।”

মিয়ানমারের অন্য জনগোষ্ঠীর নাগরিকরা যেভাবে জীবন-যাপন করছে, রোহিঙ্গারাও সেভাবে করতে পারলে ফিরে যাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা, ভিটে-মাটির পাশাপাশি রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তড়িঘড়ি প্রত্যাবাসন করলে আবারও ২০১৭ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকে যাবে।”

প্রসঙ্গত, গত ৩০ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে চীনের সম্পৃক্ততায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের মধ্যস্থতায় বিকল্প উদ্যোগের আওতায় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত সংখ্যক রোহিঙ্গার টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে আলোচনা হয়।

২০২১ সালের অক্টোবরে পাইলট প্রকল্পের অধীনে ৭১১ জন মুসলিম রোহিঙ্গা এবং ৩১৭ জন হিন্দু রোহিঙ্গার দুটি তালিকা পাঠানো হয়। দুই পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত না হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়া স্থবির হয়েছিল। সম্প্রতি পাইলট প্রকল্পটির মাধ্যমে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি সামনে আসে। যদিও প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।