জাতিসংঘের পর এবার ভাসানচর যাচ্ছেন ১০ দেশের রাষ্ট্রদূত

জেসমিন পাপড়ি
2021.04.01
ঢাকা
জাতিসংঘের পর এবার ভাসানচর যাচ্ছেন ১০ দেশের রাষ্ট্রদূত নোয়াখালীর ভাসানচর আবাসন প্রকল্পে ঘরের পাশের চায়ের দোকানে কয়েকজন রোহিঙ্গা। ৩০ ডিসেম্বর ২০২০।
[এএফপি]

জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের পরে এবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তাকারী বিভিন্ন দেশের ১০ জন রাষ্ট্রদূত নোয়াখালীর ভাসানচর পরিদর্শনে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নোয়াখালী জেলার ওই দ্বীপটিতে ১৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আগামী ৩ এপ্রিল তাঁরা ভাসানচর পরিদর্শন করবেন বলে বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাইকমিশন। 

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, জাপান, নেদারল্যান্ড ও কানাডার মিশন প্রধানরা এই সফরে থাকবেন বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এসব রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল যোগানদাতা। 

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও সেবা সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতরা সরেজমিনে দেখবেন। এ ছাড়া সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলারও সুযোগ পাবেন।” 

“সফরের পর রাষ্ট্রদূতেরা ভাসানচর প্রকল্প নিয়ে সরকার, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য অংশীদারদের সাথে সংলাপ অব্যাহত রাখতে আগ্রহী। এ বিষয়ে সরকার এবং জাতিসংঘের মধ্যে নীতি ও কারিগরি বিষয়ে সংলাপ প্রয়োজন,” যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। 

এর আগে ১৭ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত জাতিসংঘের একটি দল ভাসানচর পরিদর্শন করে। 

দ্বীপটি বসবাসযোগ্য কি না তা জানতে ১৩ থেকে ১৫ মার্চ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন রেডক্রস অ্যান্ড রেডক্রিসেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেড ক্রস এবং অন্যান্য সহযোগীদের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর সফর করে।

এই দলটি ভাসানচরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহ মানবিক সহায়তা প্রদানে আরও ত্রাণ প্রয়োজন বলে মত দিয়ে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে।

তবে রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্টের এই পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “তাঁরা যা বলছেন, সব ঠিক নয়। সরকারের সবরকম ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে।” 

দীর্ঘদিন পরে হলেও জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের ভাসানচর পরিদর্শনকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “ভাসানচর সম্পর্কে ভুল ধারণা আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করেছে। বিদেশি দূতদের এই সফরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নতুন এই আবাসন সম্পর্কে আরো স্বচ্ছ ধারণা পাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।” 

“আশা করি এরপর যে সাহায্য (রোহিঙ্গাদের জন্য) প্রয়োজন সেটা নিয়ে তাঁরা এগিয়ে আসবেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়েও জোরালো ভূমিকা রাখবেন,” বলেন তিনি। 

ভাসানচরের বাসযোগ্যতা কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ও বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা সেটা দেখতে পাবেন।” 

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন। 

কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভাসানচর দ্বীপকে প্রস্তুত করে সরকার। 

তবে শুরু থেকেই পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা বিষয়ক টেকনিক্যাল প্রোটেকশন অ্যাসেসমেন্ট করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল জাতিসংঘ। 

রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভাসানচর পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। 

পরিদর্শন শেষে দ্বীপটিতে আবাসন পরিকল্পনা শুরুর আগে জাতিসংঘকে সেখানে “পূর্ণাঙ্গ কারিগরি, মানবিক ও নিরাপত্তা সমীক্ষা চালাতে অনুমতি দেওয়ার” জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। 

তবে সমীক্ষা ছাড়াই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে গত ডিসেম্বর থেকে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ভাসানচর স্থানান্তর শুরু করে সরকার। 

গত ১৭ মার্চ জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল প্রথম ভাসানচর সফর করে। 

এর আগে মার্চের শুরুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম ভাসানচর পরিদর্শন করে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি’র একটি প্রতিনিধিদল। 

ভাসানচরে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়ালো 

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ষষ্ঠ দফার প্রথম দলে ২ হাজার ১২৫ জন রোহিঙ্গা নোয়াখালী ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন ভাসানচর আশ্রায়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর রাশেদ সাত্তার। 

রাশেদ সাত্তার জানান, এসব রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জাহাজে করে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভাসানচরে পৌঁছান। এর আগে বুধবার সকালে বাসে করে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয় তাঁদের। এরা সবাই স্বেচ্ছায় ভাসানচর গিয়েছেন। 

এই নিয়ে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার ৮৪৮ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলো। এর আগে গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে রাখা হয়। 

সব মিলিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া শুক্রবার আরো দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গার ভাসানচরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে বলে জানান কমোডোর রাশেদ সাত্তার। 

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।