ভাসানচরে ভালো আছেন, তবে দ্বীপের বাইরে যাবার সুযোগ চান রোহিঙ্গারা
2021.04.05
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তাকারী দশ দেশের রাষ্ট্রদূতদের ভাসানচরে বসবাসকারী শরণার্থীরা জানিয়েছেন, দ্বীপটিতে তাঁরা ভালো আছেন তবে কক্সবাজারের স্বজনদের সাথে যোগাযোগ ও কেনাকাটার জন্য নোয়াখালী যাতায়াতের সুযোগ চান তাঁরা।
জাতিসংঘ ও রেডক্রস প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে আসার পর গত শনিবার সেখানকার শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও জীবনযাপন সম্পর্কে সরেজমিন দেখতে যান ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের ১০ জন রাষ্ট্রদূত।
প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার এ সফরে তাঁরা ভাসানচরের সামগ্রিক অবস্থা জানার চেষ্টা করেন বলে বেনারকে জানান রাষ্ট্রদূতদের সফরসঙ্গী এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শাহ রেজওয়ান হায়াত।
“রাষ্ট্রদূতেরা জানতে চান, ভাসানচরে রোহিঙ্গারা কেমন আছেন এবং তাঁরা স্বেচ্ছায় এসেছেন কিনা। জবাবে রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, তাঁরা কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচরে অনেক ভালো আছেন,” জানান প্রত্যাবাসন কমিশনার।
“ভাসানচরের সবকিছুই বিদেশি কূটনীতিকেরা ঘুরে দেখেছেন,” জানিয়ে রাষ্ট্রদূতদের অপর সফরসঙ্গী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. মোহসীন বেনারকে বলেন, “তাঁরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন।”
“পাশাপাশি সেখানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজে যুক্ত বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং মানবিক সেবা সহায়তাকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন,” বলেন ত্রাণসচিব।
তাঁর মতে, “সব কিছু বিবেচনায় তাঁরা বেশ ইতিবাচক ধারণা পেয়েছেন বলে মনে হয়েছে। এ বিষয়ে হয়তো তাঁরা পরে জানাবেন।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে গত শনিবার এই সফরের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সফরের দুই সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১০ বিদেশি রাষ্ট্রদূত দ্বীপটি পরিদর্শনে গেলেন।
ভাসানচরে সরকারের নেওয়া উন্নয়ন ও মানবিক কার্যক্রম কূটনীতিকদের দেখানো এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল বলে শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এই সফর সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতদের বক্তব্য জানতে চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ঢাকাস্থ কয়েকটি দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে বেনারকে জানানো হয়, এ বিষয়ে তারা এখনই কোনো মন্তব্য দিতে চায় না।
“কূটনীতিক দল ভাসানচর ঘুরে এসে সাথে সাথে মন্তব্য করার কথা নয়। সম্ভবত টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘ বা বিভিন্ন দেশের দূতাবাস এ বিষয়ে মন্তব্য করবে না,” পরিদর্শন শেষে দূতাবাসগুলোর নীরবতা সম্পর্কে বেনারকে বলেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান।
তবে জাতিসংঘ বা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ভাসানচর যাওয়া ইতিবাচক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা একটা অগ্রগতি। কারণ, ভাসানচরে যাওয়া বা না যাওয়া নিয়ে যে টানাপোড়েন ছিল, সেটি দূর হচ্ছে বলে মনে হয়।”
“জাতিসংঘের মতামত সাপেক্ষেই ভাসানচরের বিষয়গুলো ভাবতে হবে,” জানিয়ে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “রোহিঙ্গারা আমাদের নাগরিক নয়। তাঁরা আমাদের ভৌগলিক সীমানায় আশ্রয় নিলেও তাঁদের দেখভাল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই করছে।”
দ্বীপের বাইরে যাতায়াত সুবিধা চান রোহিঙ্গারা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচরের নিরাপদ ও অপরাধমুক্ত পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টির কথা রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রদূতদের কাছে তুলে ধরেন।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শাহ রেজওয়ান হায়াত জানান, পরিদর্শনকালে কূটনীতিকেরা দ্বীপের রোহিঙ্গাদের থাকার ঘর, শিশুদের স্কুল এবং দ্বীপের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। সেখানে নির্মিত উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে খুদে শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও সময় কাটান তাঁরা।
শনিবার রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠকে ভাসানচরের ২১ জন পুরুষ এবং ২০ জন রোহিঙ্গা নারী উপস্থিত ছিলেন বলে বেনারকে জানান সেখানকার রোহিঙ্গা নেতা নুর হোসেন।
“ভাসানচরে রোহিঙ্গারা বর্তমানে কেমন আছে, স্বেচ্ছায় ভাসানচরে এসেছে কিনা, কক্সবাজারের তুলনায় এখানকার জীবনযাত্রার মান কেমন-এসব বিষয়ে জানতে চান রাষ্ট্রদূতরা,” টেলিফোনে বেনারকে বলেন নুর হোসেন।
তিনি বলেন, “আমরা রাষ্ট্রদূতদের বলেছি, কক্সবাজারের শিবিরগুলোর ঘিঞ্জি পরিবেশ, বর্ষায় পাহাড় ধ্বস-বন্যা হয়, ছেলে মেয়েদের খেলার মাঠ নেই। এ ছাড়া আছে মারামারি, মাদক ও অপহরণের ঘটনা।”
নুর জানান, রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রদূতদের বলেছেন, “ভাসানচরে এসব ঝামেলা নেই। ভাসানচর খোলামেলা সমতল জায়গা, ঘরগুলো অনেক সুন্দর, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ আছে, চাষাবাদের সুবিধা আছে।”
তবে এস সময় রোহিঙ্গারা “কূটনীতিকদের কাছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে স্বজনদের সাথে দেখা করা এবং কেনাকাটার জন্য নোয়াখালী সদরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার আবেদন করেন,” বলে জানান নুর হোসেন।
‘সরকারের উচিত কারিগরি মূল্যায়নের অনুমতি দেওয়া’
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি আলাদা হেলিকপ্টারে করে শনিবার ভাসানচর সফরে যান বাংলাদেশে কর্মরত দশ রাষ্ট্রদূত।
সফরকারী দশ রাষ্ট্রদূত হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের আর্ল আর মিলার, যুক্তরাজ্যের রবার্ট ডিকসন, কানাডার বেনোয়া প্রিফঁতেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রেনজি টিরিংক, ফ্রান্সের জ্যাঁ মারিও সুশো, জার্মানির পিটার ফারেনহল্টৎস, নেদারল্যান্ডসের হ্যারি ভারউইজ, জাপানের নাওকি ইতো, অস্ট্রেলিয়ার জেরেমি ব্রুয়ার এবং তুরস্কের মুস্তাফা উসমান তুরান।
এ ছাড়া পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনও তাঁদের সফরসঙ্গী ছিলেন।
এর আগে ১৭-২০ মার্চ জাতিসংঘের একটি দল ভাসানচর পরিদর্শন করে। ওই সফরের পরে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
তবে গত ১৩ থেকে ১৫ মার্চ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন রেডক্রস অ্যান্ড রেডক্রিসেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেড ক্রস এবং অন্যান্য সহযোগীদের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর সফর করে।
এই দলটি ভাসানচরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহ মানবিক সহায়তা প্রদানে আরও ত্রাণ প্রয়োজন বলে মত দিয়ে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে।
এর আগে মার্চের শুরুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম ভাসানচর পরিদর্শন করে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি’র একটি প্রতিনিধিদল।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
সব মিলে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভাসানচর দ্বীপকে প্রস্তুত করে সরকার।
তবে শুরু থেকেই পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা বিষয়ক টেকনিক্যাল প্রোটেকশন অ্যাসেসমেন্ট করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল জাতিসংঘ।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভাসানচর পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি।
পরিদর্শন শেষে দ্বীপটিতে আবাসন পরিকল্পনা শুরুর আগে জাতিসংঘকে সেখানে “পূর্ণাঙ্গ কারিগরি, মানবিক ও নিরাপত্তা সমীক্ষা চালাতে অনুমতি দেওয়ার” জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তবে সমীক্ষা ছাড়াই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে গত ৪ ডিসেম্বর থেকে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ভাসানচর স্থানান্তর শুরু করে সরকার।
এ পর্যন্ত সেখানে ১৮ হাজার ৩৩৪ জন শরণার্থীকে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে শনিবারের বিবৃতিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মানবাধিকার কর্মী নূর খানের মতে, “জাতিসংঘসহ বিদেশি প্রতিনিধি দলকে ভাসানচর পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়ার পরে এখন সরকারের উচিত দ্বীপটির টেকনিকাল অ্যাসেসমেন্টের অনুমতি দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরেই যেটার জন্য জাতিসংঘ অনুমতি চেয়ে আসছে।”
পাশাপাশি সরকারের নিজস্ব একটি টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।