মিয়ানমার পাঠানোর উদ্যোগ ব্যর্থ, স্বস্তিতে ভারতে বন্দি রোহিঙ্গা কিশোরীর পরিবার
2021.04.05
ঢাকা ও কক্সবাজার
দুই বছর ভারতে বন্দি থাকার পর মিয়ানমারে ফেরত যেতে হয়নি বলে ১৪ বছরের রোহিঙ্গা কিশোরী ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দুই বছর ধরে আসামে আটক ওই কিশোরীকে গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার কর্মীরা ভারতের ওই উদ্যোগের সমালোচনা করে আসছে। মিয়ানমার ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে এখন সে আবারও আসামে ফিরেছে।
মণিপুরের মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসামে ফেরত আসার পর মেয়ের সাথে মুঠোফোনে আলাপের কথা জানিয়ে কক্সবাজারে বসবাস করা ওই কিশোরীর বাবা মো. জাবের আক্তার (৪৩) বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে ফিরতে হয়নি বলে সে খুবই খুশি। এখন সে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে আমাদের কাছেই ফিরতে চায়।”
“আমার মেয়েকে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁকে মা–বাবা অর্থাৎ আমাদের কাছে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করবেন,” যোগ করেন ওই বাবা।
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মাদ দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “ওই রোহিঙ্গা কিশোরীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো উচিত। কারণ যেখানকার নাগরিক সেখানে পাঠানোই যৌক্তিক ও আইনসম্মত।”
“কূটনৈতিকভাবে ভারত থেকে কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তারা এখানকার নাগরিক নয়। কোনো দেশ চাইলে শরণার্থীদের এখান থেকে তাদের দেশে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কাউকে আমাদের এখানে পাঠাতে পারে না,” যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
ওই কিশোরীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে মণিপুরের তেংনৌপাল জেলার সরকারি এক কর্মকর্তা মায়াংলম্বম রাজকুমার বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “আমরা মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ করেছি, তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি।”
এই পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করেন তিনি। ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্ররা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাইছেন না বলেও জানিয়েছে রয়টার্স।
বেনারের পক্ষ থেকে আসাম পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে মিয়ানমারের অভিবাসন বিভাগ আন্তর্জাতিক সীমান্তের দরজা খুলতে চায়নি বলে জানিয়েছে একাধিক ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস ও রয়টার্স জানিয়েছে, ওই কিশোরীকে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরের সেই আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরত পাঠানো হয়েছে, যেখানে গত দুই বছর ধরে সে ছিল।
কেন্দ্রটি পরিচালনাকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নিবেদিতা নারী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা দিবা রায় সোমবার এক ই-মেইলের জবাবে কিশোরীর ফিরে আসার বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন।
“মিয়ানমারে যাওয়া এড়িয়ে ফিরে আসতে পেরে সে বেশ খুশি,” জানান দিবা রায়।
বিষয়টি এখন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক দেখবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “শিশুটির আগ্রহকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে পরিবারের সাথে একত্রিত করার চেষ্টা করা হবে।”
ভারতের মণিপুর রাজ্যের জেলা তেংনৌপালের মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে মেয়েটির ফিরে যাওয়ার কথা তাঁর বাংলাদেশে অবস্থানকারী পরিবারের সদস্যরাও বেনারকে নিশ্চিত করেন।
পরিচয় গোপন রেখে ভারতের এক অভিবাসন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, “বর্তমানে বাবা-মা বাংলাদেশে থাকায় মেয়েটি মিয়ানমারে যেতে রাজি নয়।”
হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, আসাম পুলিশের আট সদস্য মেয়েটিকে নিয়ে মণিপুর রাজ্যের একটি সীমান্ত থেকে ফিরে এসেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে এসে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালংয়ে সপরিবারে আশ্রয় নেন জাবের আক্তার।
পরিবারের বাকি ছয় সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশে বসবাসকারী জাবের জানান, মেয়েকে ফেরত পাওয়ার জন্য তিনি বহুবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র লুইস ডনোভানকে ইমেইল পাঠিয়ে কোনো জবাব মেলেনি।
তবে কথা বলেছেন আরআরআরসি শাহ্ রেজওয়ান হায়াত। বেনারকে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের জানিয়ে লাভ নেই। বিদেশ থেকে কোনো শরণার্থী আসবে কিনা, সে বিষয়ে ইউএনএইচসিআর হয়তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করবে।”
অনুরোধ পায়নি বাংলাদেশ
বেনার প্রতিনিধির কাছ থেকেই ওই কিশোরীর খবরটি জানার কথা উল্লেখ করেন ডিজি দেলোয়ার। তাঁর ব্যাপারে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো অনুরোধ পায়নি উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “তাকে পরিবারের সাথে একত্রিত করার বিষয়টি অন্যভাবেও হতে পারে, এখানে যারা আছে তাদের কি সেখানে নেওয়া যায় না?”
“যতটুক সামর্থ্য তার চেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গাদের জন্য করেছে বাংলাদেশ। এখন অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোরও তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “মাত্র ১৪ বছরের এক উদ্বাস্তু কিশোরী দুই বছর ধরে অভিভাবকহীন অবস্থায় বন্দি আছে, তাঁকে যে কোনো উপায়ে পরিবারের সাথে একত্রিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার। দুই দেশের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে দ্রুত সেই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।”
“কোনো অবস্থাতেই তাঁকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা দেশটির সামরিক সরকারের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না,” যোগ করেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এই মহাসচিব।
ভারতীয় মানবাধিকার কর্মীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে তিনি ইতোমধ্যে মেয়েটির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছেন জানিয়ে লিটন আরো বলেন, বিষয়টির আইনগত দিকগুলো খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা।
ভারতে সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মানবাধিকার কর্মী তপন বোস ও তাঁর সহকর্মীরা এটা নিয়ে সোচ্চার আছেন বলেন জানিয়েছেন নূর খান লিটন।
ইতিমধ্যে জাতিসংঘও ওই কিশোরীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ায় নয়াদিল্লির সমালোচনা করেছে এবং কর্তৃপক্ষকে প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার আহবান জানিয়েছে।
“মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং টেকসই পদ্ধতিতে স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার জন্য এখনও উপযুক্ত নয় এবং মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া মাত্রই শিশুটি গুরুতর ক্ষতির ঝুঁকিতে ফেলতে পারে,” জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার এ কথা জানায় আলজাজিরা ও রয়টার্স।
মেয়েটি যেভাবে ভারত যায়
বেনারকে জাবের জানান, ২০১৯ সালে মার্চ মাসে উখিয়ার জামতলীতে মামার কাছে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয় তাঁর বড় মেয়ে। তার বয়স তখন ছিল ১২ বছর।
জাবের জানান, সেখান থেকে কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে যাত্রা করে সে। ভারতীয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মেয়েটি। অন্যান্য সঙ্গীদের সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
“মেয়েকে ফেরত আনতে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে অনেক ঘোরাঘুরি করছি, কোনো সমাধান পাইনি,” বলেন জাবের।
বাংলাদেশে আসার আগে বুশিডংয়ের থমবাজার এলাকায় চাষাবাদ করে পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে ভালো ছিলেন বলেও জানান মিয়ানমারের ওই নাগরিক। তিনি বলেন, মেয়েটি তার কাছে ফিরে আসুক, এটিই একমাত্র চাওয়া।