ভাসানচরেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা, দুশ্চিন্তায় শরণার্থীরা

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2021.04.09
ঢাকা ও কক্সবাজার
ভাসানচরেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা, দুশ্চিন্তায় শরণার্থীরা ভাসানচর আশ্রয় কেন্দ্রের বারান্দায় দোলনায় খেলছে দুই রোহিঙ্গা শিশু। ৩০ ডিসেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজের বিশেষ ছবি]

বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নেশাজাতীয় ট্যাবলেট ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। পুলিশের দাবি কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ওই দ্বীপে যাবার সময়ই শরণার্থীরা সেখানে এই মাদক নিয়ে গেছেন। 

ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহে আলম বেনারকে জানান, গত ১৯ জানুয়ারি থানাটি উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২৩৩ পিস ইয়াবাসহ চারজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

“মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি। 

সর্বশেষ বুধবার ৬০৩ পিস ইয়াবাসহ নুর মোহাম্মদ নামের এক রোহিঙ্গাকে আটকের কথা জানান এই কর্মকর্তা।

এর আগে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩০ পিস ইয়াবাসহ একজন এবং মার্চের শেষ সপ্তাহে ছয়শ পিস ইয়াবাসহ আরো দুইজনকে আটক করে পুলিশ। 

“প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে আসার সময় নিজেদের জিনিসপত্রের মধ্যে করে এসব ইয়াবা নিয়ে এসেছিল তারা,” বেনারকে বলেন ওসি মাহে আলম। 

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর থেকে ছয় দফায় মোট ১৭ হাজার ৯৯৫ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে গেছে সরকার।

এর আগে গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে রাখা হয়েছিল।

সব মিলে এখন দ্বীপটিতে রয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। 

ভাসানচরে ইয়াবা পৌঁছে যাওয়া দুশ্চিন্তার

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সহিংসতার অন্যতম কারণ ছিল ইয়াবা ব্যবসা, এমনটা দাবি করে ভাসানচরের রোহিঙ্গা নেতা নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে বেনারকে জানান, সেখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। 

তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম ভাসানচরে এসে অন্তত শান্তিতে থাকা যাবে। কিন্তু এখানেও ইয়াবা পৌঁছে যাওয়াটা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।” 

“মাদক ব্যবসা শুরু হলে ভাসানচরেও অশান্তি নেমে আসবে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন টেকনাফের লেদা ডেভলমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।

যারা সেখানে মাদক ব্যবসা চালুর চেষ্টা করছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের দ্বীপে নেবার সময় তাঁদের মালপত্রের ব্যাগগুলো কঠোরভাবে তল্লাশি না করায় তাঁরা মাদক বহনের সুযোগ পাচ্ছে।” 

কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে ভাসানচরগামী রোহিঙ্গাদের প্রথমে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে এনে রাখা হয়। সেখান থেকে তাঁদের চট্টগ্রামে জাহাজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ পাহারায়। 

তবে ওই সময় কাউকে তল্লাশি করা হয় না বলে বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ (এপিবিএন) এর অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান। 

তিনি বলেন, “উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে জাহাজ পর্যন্ত তাঁদের নিরাপদে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করি আমরা। এর আগে অন্যান্য বাহিনী তাঁদের দেখভাল করে।” 

বিশ্লেষকদের মতে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ার কারণে ভাসানচরকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো মাদকের রুট তৈরি হওয়া কঠিন হলেও সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে মাদক ব্যবসার সম্পর্কটা সর্বজনবিদিত। সেখান থেকে যারা ভাসানচরে গিয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত সেই চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল।” 

“বিগত কয়েক দশক ধরে মাদক ব্যবসাই কর্মক্ষম রোহিঙ্গাদের মূল পেশা,” মন্তব্য করে জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “তাদের ইয়াবা ব্যবসার যে নেটওয়ার্ক আছে, তা ভাসানচরের চেয়ে বিচ্ছিন্ন এলাকায় নিয়ে গেলেও তারা বিস্তৃত করার চেষ্টা করবে।” 

“যতদিন পর্যন্ত তারা এখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত না যাবে, ততদিন এখানে এটা বন্ধ করা যাবে না,” যোগ করেন মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) এই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। 

ভাসানচর ছেড়ে পালিয়েছেন এক রোহিঙ্গা

অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ৩০৬ জন রোহিঙ্গা। তাঁদেরকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচর নিয়ে যায় সরকার। 

এদের মধ্যে একজন ভাসানচর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, অন্য নয়জনকে পালানোর চেষ্টাকালে আটক করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ভাসানচরের ওসি মাহে আলম। 

“তাঁরা দলগতভাবে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু আমরা সেটা ব্যর্থ করে দিয়েছি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এক রোহিঙ্গার পালানোর খবরটি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।” 

পলাতক রোহিঙ্গার পরিচয় না জানালেও তিনিও সেই ৩০৬ জনের একজন বলে নিশ্চিত করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। 

ওসির ধারণা, ভাসানচরের কাছাকাছি মাছ ধরতে আসা নৌকা বা ট্রলারে করে পালিয়েছেন ওই রোহিঙ্গা। 

এর আগে বহুবার কক্সবাজারের শিবিরে স্বজনদের কাছে ফেরার দাবি জানিয়েছিলেন ওই ৩০৬ শরণার্থী। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। 

ভাসানচরের এসব ঘটনা সম্পর্কে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) অবহিত কি না জানতে চেয়ে তাদের কক্সবাজার কার্যালয়ের মুখপাত্র লুইস ডোনোভানকে ইমেইল করলে তিনি অফিসে নেই বলে স্বয়ংক্রিয় জবাব পাওয়া যায়। 

পরে সংস্থাটির সহকারী কমিউনিকেশন অফিসার মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভাসানচরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে সেখানকার সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। 

মার্চের ১৭ থেকে ২০ তারিখ প্রথমবারের মতো ভাসানচর পরিদর্শন করে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল। তবে পরিদর্শনের পর এখন পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনো বিবৃতি বা প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি তারা। 

ভাসানচর থেকে ফিরে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল এখন পর্যন্ত “সরকারকেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি,” বলে শুক্রবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মাদ দেলোয়ার হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।