রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশের চুক্তি

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.04.13
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
টেকনাফের হোয়াইক্যং শরণার্থী শিবিরে নিজের ঘরের সামনে হাত পাখায় বাতাস করছে এক রোহিঙ্গা কিশোরী। টেকনাফের হোয়াইক্যং শরণার্থী শিবিরে নিজের ঘরের সামনে হাত পাখায় বাতাস করছে এক রোহিঙ্গা কিশোরী। ২০ মার্চ ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। শুক্রবার ইউএনএইচসিআর এর হাইকমিশনার ফিলিপো গ্র্যান্ডি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক জেনেভায় ওই চুক্তি সই করেন।

এতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে শরণার্থীদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সঙ্গে নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে দুই পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে ইউএনএইচসিআর এর এক বিবৃতিতে জানানো হয়।

গত বছরের ২৩ নভেম্বর ঢাকা ও নেপিদোর মধ্যে মিয়ানমারের ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের’ ফলে দেশ ছাড়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, “যদিও ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর একসঙ্গে কাজ করেছিল, তবে বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর এ দফায় মিয়ানমারের বিরোধিতার কারণে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারছিল না।”

কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআরের কার্যক্রম প্রধান কেভিন অ্যালেন গত ১১ এপ্রিল সফররত মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়েকে জিজ্ঞেস করেন, মিয়ানমার ইউএনএইচসিআরকে সে দেশে প্রবেশ করতে দেবে কি না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “প্রত্যাবাসনে আমাদের ইউএনএইচসিআরকে প্রয়োজন, কারণ এ বিষয়ে তাদের ব্যাপক দক্ষতা আছে। ইউএনএইচসিআর আমাদের প্রত্যাবাসন ফরম পূরণে এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবে।”

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআরের সম্পৃক্ততায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

“আমরা আরাকানে (রাখাইন) ফিরে যেতে চাই। কিন্তু মিয়ানমারকে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা জাতিসংঘকে বিশ্বাস করি। ইউএনএইচসিআর যেভাবে বলবে আমরা সেভাবেই করব,” বেনারকে বলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের একজন শরণার্থী নেতা।

শুক্রবারের বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর জানায়, “ইউএনএইচসিআর মনে করছে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া ও স্থায়ীভাবে সেখানে অবস্থানের মতো অনুকূল পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি।”

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়িত্ব মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এবং তা শুধু অবকাঠামো তৈরি ও যান্ত্রিক সুযোগ–সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।”

এদিকে বৃহস্পতিবার সৌদি বাদশার ত্রাণ তহবিল থেকে রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তার জন্য তিন মিলয়ন ডলার অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৪৭ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা ঘোষণা করা হয়। ২০১৬ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরু হবার পর থেকে দেশটি শরণার্থীদের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে।

৬৭০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম যাচাই–বাছাই

গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর নামের তালিকা যাচাই–বাছাইয়ের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে।

বাংলাদেশের রিফিউজি, রিলিফ অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম গত ১০ এপ্রিল কক্সবাজারে বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তিন দফায় ৬৭০ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে। যাচাই–বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিক। আশা করি, তারা আরও বেশি সংখ্যক ব্যক্তির যাচাই–বাছাই দ্রুত শেষ করবে।”

তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, ফরমগুলো ঠিকভাবে পূরণ করা হয়নি।

“ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসনের ফরমগুলো পূরণে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে,” বলেন আবুল কালাম।

“ইউএনএইচসিআর, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি না থাকায় দুটি আলাদা সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শরণার্থীরা স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরতে পারে,” শুক্রবারের বিবৃতিতে জানায় ইউএনএইচসিআর।

ইউএনএইচসিআরের হিসেবে, গত আগস্টের পর মিয়ানমারের চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে ৬ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। আগে থেকেই বাংলাদেশে আরও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ছিল। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে।

শরণার্থী সংস্থা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আতিথেয়তা, সুরক্ষা ও সহযোগিতা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গিয়েছিল। তবে গত বছরের ২৫ আগস্টের পরের সহিংসতা আর সব সহিংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। শরণার্থীদের যে ঢল তাও ছিল অভূতপূর্ব।

মিয়ানমার সরকার রাখাইনে গত ২৫ আগস্টের পর যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে তাতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ ওঠে।

মিয়ানমার বলছে, তাদের এই ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স ছিল আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে (আরসা) দমনের জন্য। কারণ আরসা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল।

জাতিসংঘ রাখাইনের এই ক্লিয়ারেন্স অপারেশনকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করেছে।

গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। ওই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কীভাবে হবে সে বিষয়ে চুক্তি করে। কিন্তু এরপর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়।

ইউএনএইচসিআর বলছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা জানিয়েছে, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁরা রাখাইনে তাঁদের অবস্থান, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে আইনগত কী কী সুবিধা রয়েছে সে সম্পর্কে প্রকৃত অগ্রগতি দেখতে চায়।

“রাখাইনে অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুতির মূল কারণ অনুসন্ধান করে মিয়ানমার সরকারের প্রতি সত্যিকারের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর,” ওই বিবৃতিতে বলা হয়।

ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “মিয়ানমার সরকার এই মুহূর্তে ইউএনএইচসিআর ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে পূর্ণাঙ্গ ও নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার দিতে পারে। এতে করে ইউএনএইচসিআর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে শরণার্থীরা যে জায়গা থেকে এসেছে সেখানকার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে তাঁদের প্রত্যাবাসন ও খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টি নজরদারি করতে পারবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।