ভাসানচরে স্থানান্তর করা রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল দাবি বাংলাদেশের

জেসমিন পাপড়ি
2021.04.16
ঢাকা
ভাসানচরে স্থানান্তর করা রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল দাবি বাংলাদেশের নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসন প্রকল্প। মার্চ ১৩, ২০২১।
বেনার নিউজ

পর্যায়ক্রমে ভাসানচরে স্থানান্তরিত এক লাখ রোহিঙ্গার দায়িত্ব জাতিসংঘ গ্রহন না করলে তাদের নামে সংগ্রহ করা আন্তর্জাতিক তহবিলের ১০ শতাংশ বাংলাদেশ দাবি করবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, “এই তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য। তারা যদি ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের পরিষেবা দিতে না চায়, তাহলে আমরা ১০ শতাংশ তহবিল দাবি করব। সেটা তাদের দিতে হবে।”

শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করে আসলেও সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল দ্বীপটি পরিদর্শনের পরে তারা কিছুটা নমনীয় বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই প্রতিনিধি দলটির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জাতিসংঘ ১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেবে।

“ইতোমধ্যে তারা দুই পৃষ্ঠার একটি সারসংক্ষেপ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে, সেখানে তাদের পর্যবেক্ষণ খুব ভালো ও ইতিবাচক,” বলেন তিনি।  

তবে ভাসানচরে অর্থায়নের বিষয়ে জাতিসংঘের এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। বরং তারা সরকারের সাথে এ বিষয়ে আরো আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।

 এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র চার্লি গুডলেক বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে যে কোনো ধরনের কার্যক্রমে জাতিসংঘের জড়িত হতে অথবা অর্থায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের (অংশীজন) এবং বিশেষত দাতাদের সাথে সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে একমত হতে হবে।”

 তারা আরও বলেন, জাতিসংঘ মনে করে, আরও শরণার্থী স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পর্যান্তক্রমিক এবং ধাপ ভিত্তিক পদক্ষেপ অনুসরণ করা উচিত যাতে ভাসানচরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা যায়।

 ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। আগের ও তখনকার মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছেন।

কক্সবাজার থেকে এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। তবে শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে জাতিসংঘ।

 জাতিসংঘের বিরোধিতার মুখেই গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। এরপর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ছয় ধাপে ১৭ হাজার ৯৯৫ জনকে ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে।

গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে উদ্ধার ৩০৬ রোহিঙ্গাকেও সেখানে রাখা হয়। সব মিলিয়ে দ্বীপটিতে এখন ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে গত ১৭ থেকে ২০ মার্চ বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সহকারী প্রতিনিধি ফুমিকো কাশিওয়ার নেতৃত্বে জাতিসংঘের ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর সফর করে।

 ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র চার্লি গুডলেক জানান, “এই প্রতিনিধি দলের সফর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের বিদ্যমান মানবিক ও সুরক্ষা প্রয়োজনীয়তার প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছে।”

 “তারপরও রোহিঙ্গাদের মানসম্মত জীবন ও কল্যাণে ভবিষ্যতে ভাসানচরের ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড কীভাবে পরিচালিত হবে সে নীতিমালার বিষয়ে আলোচনা করতে সরকারকে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিনিধি দল,” বলেন তিনি।

  

চারটি বিষয়ে জাতিসংঘের গুরুত্বারোপ

সরকারকে দেওয়া সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে জাতিসংঘ ভাসানচরের বেড়িবাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষা, রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার উপর গুরুত্বারোপ করেছে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রী।

এ বিষয়ে ড. মোমেন বলেন, “রোহিঙ্গাদের শিক্ষা দিতে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই। তবে অবশ্যই সেটা মিয়ানমারের ভাষায় হওয়া উচিত।”

“কারণ, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে। দেশে ফিরে সহজেই নিজেদের সমাজে মিশতে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমের শিক্ষা তাদের সহায়তা করবে,” মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

ভাসানচরের বাঁধের উচ্চতা বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এটা আমরা করবো।”

যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে কেউ সন্দ্বীপ হয়ে ভাসানচরে যেতে পারবেন। এই পথে মাত্র ৩০ মিনিটে ভাসানচরে পৌঁছানো সম্ভব। এক্ষেত্রে যোগাযোগের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ভাসানচর বাংলাদেশের ৭৫টি দ্বীপের একটি এবং এটি সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়েও ১০ গুণ বড় বলেও জানান তিনি।

জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তাকারী বিভিন্ন দেশের ১০ জন রাষ্ট্রদূত ভাসানচর পরিদর্শন করেন।

তারা ভাসানচরের সার্বিক ব্যবস্থা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ ছাড়া গত ৯ এপ্রিল ঢাকা সফরের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরে প্রকল্প নেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।

স্থান নয়, সেবা নিয়ে ভাবতে হবে: মোমেন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। আমরা তাদের কোথায় রাখব তা নিয়ে জাতিসংঘের মাথাব্যথা হওয়া উচিত নয়।”

ড. মোমেন বলেন, “রোহিঙ্গারা কুতুপালং, কক্সবাজার, বরিশাল নাকি ভাসানচরে বাস করছে—সেটা বিষয় নয়। জাতিসংঘের মাথাব্যথা হওয়া উচিত রোহিঙ্গাদের সেবা দেওয়া নিয়ে।”

“রোহিঙ্গারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের দেখভাল বা পরিষেবা দিতে মানবিক সংস্থাগুলো বাধ্য। কারণ, সেজন্য তারা ফান্ড পেয়ে থাকে,” বলেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে না পালন করলে সদস্য রাষ্ট্রগুলো তহবিল গঠনে সহায়তা করবে না। ফলে তারা তীব্র অর্থ সংকটে মুখে পড়বে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইউএনএইচসিআর এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের নামে অর্থ সংগ্রহ করে। অথচ আমরা এখন পর্যন্ত জানি না সেই অর্থ কীভাবে ব্যয় হয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।