প্রস্তুতি শেষ করে করোনা টিকার অপেক্ষায় রোহিঙ্গা শিবির
2021.04.21
কক্সবাজার
দেশে করোনাভাইরাসের টিকা সংকটের কারণে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পরিকল্পনা। টিকা পাওয়া গেলে মে মাসের শেষ নাগাদ এই কর্মসূচি শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়ে এখন টিকার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান।
মার্চের শেষভাগে শিবিরগুলোতে করোনার টিকাদান শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এখন টিকার পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হলে কর্মসূচি শুরু করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করা যাচ্ছে মে মাসের শেষ নাগাদ টিকা পাওয়া যাবে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী নিবন্ধিত প্রায় সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এক লাখ ২৭ হাজার রোহিঙ্গার বয়স চল্লিশ বছরের বেশি। প্রথম ধাপে তাঁদেরকেই টিকা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
“আশা করছি, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত করোনার টিকা দেওয়া হবে। এতে রোহিঙ্গাদের দুশ্চিন্তা কমবে,” বেনারকে বলেন উখিয়ার কুতুপালং এর রোহিঙ্গা নেতা মো. রফিক।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অনেককেই রোহিঙ্গাদের সংস্পর্শে যেতে হচ্ছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান।
“রোহিঙ্গাদের করোনার টিকা দেওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি,” বলেন তিনি।
এদিকে ভারত থেকে চুক্তিমতো মার্চ-এপ্রিলে টিকার চালান না আসায় বিকল্প হিসেবে সরকার চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা কেনার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তিনি বলেন, “চীন হোক, রাশিয়া হোক, আমেরিকা হোক, যেখান থেকে পারি আমরা টিকা সংগ্রহ করব।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের আগস্টের পর সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেই বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করছেন প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা শিবিরে সংক্রমণ কম
সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের হার বাংলাদেশ জাতীয় ও কক্সবাজার জেলার হারের চেয়ে অনেক কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি দশ লাখে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার হাজার ৩০০ জন ও প্রতি দশ লাখে মৃত্যুর সংখ্যা ৬৩ জন।
জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, প্রায় ২৫ লাখ জনসংখ্যার কক্সবাজারে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ৬৬৭ বা প্রতি দশ লাখে তিন হাজার ৬০ জনের বেশি।
এখন পর্যন্ত কক্সবাজারে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ৮৬ জন বা প্রতি দশ লাখে ৩৪ জন।
অন্য দিকে আরআরআরসি কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. আবু তোহার তথ্যমতে, ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৫০৪ জন ও এই রোগে মারা গেছেন ১১ জন।
মহামারি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতির কারণেই শরণার্থীদের মধ্যে কম আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
“পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকায় শিবিরগুলো এতটা ঘনবসতি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে,” বেনারকে বলেন আরআরআরসি শাহ রেজওয়ান হায়াত।
রোহিঙ্গারা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করার কারণে সেখানে করোনা সংক্রমণের বিষয়ে ‘আশঙ্কা’ ছিল বলে বেনারকে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন।
তবে প্রথম থেকেই জনস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়া এবং শিবিরগুলোতে দেশি–বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সুসহংত ভূমিকার কারণে “স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের ব্যাপারটি রোহিঙ্গারা দ্রুত রপ্ত” করে ফেলায় এখন পর্যন্ত সেখানে সংক্রমণ ব্যাপক হয়ে ওঠেনি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “এছাড়া যখনই লক্ষণ দেখা গেছে তখনই করোনা পরীক্ষা, আইসোলেট করা, চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা খুবই দ্রুততার সাথে করা হয়েছে। ফলে করোনায় রোহিঙ্গাদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক কম।”
“শুধু করোনা নয় কলেরা, ডিপথেরিয়া ধরা পড়ার পরেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় এসব রোগেরও বিস্তার সেখানে ঘটেনি,” বলেন মুশতাক হোসেন।
শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা ও জনবল রয়েছে বলেও জানান তিনি।
করোনা আক্রান্ত বা সন্দেহজনক ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বর্তমানে শরণার্থী শিবিরে এক হাজার শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেন ডা. তোহা।
তিনি জানান, সেখানে বর্তমানে আইসোলেশানে আছেন ৫৬ জন। রোগী বাড়লে শয্যা সংখ্যাও বাড়ানোর প্রস্তুতি রয়েছে তাঁদের।
বাংলাদেশের জাতীয় ও কক্সবাজার জেলার চেয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংক্রমণের নিম্ন হারের এই চিত্র কতটা গ্রহণযোগ্য তা জানতে বেনারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত দাতা ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য চাওয়া হলেও বুধবার রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি।
মার্কিন নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা
নিজের দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে মার্কিন প্রশাসন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যাবার কারণে এই সতর্কতা জারি করা হচ্ছে বলে মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইট।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাত লাখ, ৩২ হাজার ৬০ জন, মৃত্যু হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৩ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ কোটি ৩২ লাখ ৮৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩০ লাখ ৪৯ হাজারের বেশি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।