রাখাইন দেখে এসে রোহিঙ্গারা: মিয়ানমারে নিজের ভিটায় ফিরতে চাই, ক্যাম্পে নয়
2023.05.05
কক্সবাজার
সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগে রাখাইন রাজ্যের মংডু ঘুরে এসে মিয়ানমার ফিরতে অসম্মতি জানিয়েছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল। তাঁরা বলছেন, দেশে ফিরে শিবিরে নয়, বরং নাগরিকত্বসহ নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরতে দিলেই কেবল ফিরবেন তাঁরা।
সরেজমিন ঘুরে এসে রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মিয়ানমার সরকার মংডুতে কিছু এলাকায় তাঁদের জন্য ক্যাম্প তৈরি করেছে। ক্যাম্পগুলো তাঁরা ঘুরে দেখেছেন। তবে তাঁরা ক্যাম্পে নয়, বরং নিজেদের গ্রামে নিজের ভিটায় ফিরতে চান।
মিয়ানমার থেকে শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় টেকনাফের জালিয়াপাড়ায় টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাটে পৌঁছে প্রতিনিধি দল।
নিজেদের গ্রামে ও ভিটায় ফিরতে চান রোহিঙ্গারা
রাখাইন ঘুরে এসে ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের প্রধান মোহাম্মদ সেলিম বেনারকে বলেন, “অনেক বছর পর আমাদের দেশ মিয়ানমার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমাদেরকে সেখানে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকারকে অনেক ধন্যবাদ।”
তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমারে গেছি, তারা ক্যাম্পগুলো দেখিয়েছে। আমরা জানতে চাইলাম, ক্যাম্প কেন, কার জন্য? তারা বলেছে, ‘আপনাদের জন্য’।”
“আমরা বলেছি, আমরা যদি সিকিউরিটি না পাই, নাগরিকত্ব কার্ড না পাই তাহলে কী হবে? তখন তারা জানিয়েছে, এনভিসি কার্ড (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড) নিতে হবে। আমরা বলেছি, এনভিসি কার্ড অতিথিদের জন্য। আমরা এনভিসি কার্ড নেওয়া মানে আমরাও অতিথি বা মেহমানের মতো হয়ে যাওয়া,” বলেন সেলিম।
তিনি বলেন, “আমরা দাবি করেছি, আমাদের গ্রামে আমাদের ভিটা-জমি ফিরিয়ে দিতে। আমরা নিজেদের টাকায় ঘর তৈরি করে থাকব। আমাদের শেষ কথা হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, ভিটেমাটি না দিলে আমরা ফিরে যাব না,” বলেন সেলিম।
টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাটে পৌঁছে প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য ও ক্যাম্পের বাসিন্দা আবু সুফিয়ান বলেন, “আমাদের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেছি, মিয়ানমার সেখানে ‘আইপিডি ক্যাম্প’ তৈরি করে শেল্টার করেছে। কিন্তু আমরা নিজেদের গ্রামে থাকতে চাই। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আমাদের কিছু দাবি আছে, সেগুলো মানলে ফিরে যাব।”
“সেখানে যাওয়ার মতো এখনো সুযোগ দেখছি না,” যোগ করেন তিনি।
রাখাইনের মংডু ঘুরে এসে রোহিঙ্গারা জানান, তাঁরা সকাল ১০টায় পৌঁছালে নাগপুরা, বলি বাজার ও কাজিল বিল এলাকার ক্যাম্পে সারিবদ্ধভাবে তৈরি করা শেল্টার ঘুরিয়ে দেখায় মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের বিভিন্ন গ্রামে তৈরি করা শেল্টার হোম দেখায়।
রাখাইনের বলি বাজারে বাড়ি ছিল সুবিয়া খাতুনের। ২০১৭ সালে গ্রাম ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গা নারী শুক্রবার বলি বাজর ঘুরে এসে বলেন, “সবুজে ঘেরা আমাদের গ্রাম এখন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। সেখানে তৈরি করা ঘর-বাড়িগুলো দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। আমরা সেখানে (ক্যাম্পে) যাব না। গ্রাম হিসেবে নিজেদের ঘরে থাকতে চাই।”
মিয়ানমারের সদিচ্ছা দেখেছি: শরণার্থী কমিশনার
মিয়ানমার থেকে ফিরে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দাবি বরাবরই ছিল যে, এটি যাতে সাসটেইনেবল ও ডিগনিফাইড হয়। আমাদের প্রস্তাব ছিল, প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গাদের যাতে তাদের (মিয়ানমারের) অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখানো হয়। যে কারণে আমরা এর নাম দিয়েছিলাম ‘গো অ্যান্ড সি ভিজিট’। মিয়ানমারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই তারা সে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা ২০ জন রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের মংডুর আশেপাশে যেখানে তাদের জন্য অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে সেগুলো ঘুরে দেখে আজকে ফিরেছি। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ব্রিফ করেছে, বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। আমরা প্রত্যাবাসনে সদিচ্ছা দেখেছি তাদের (মিয়ানমার)।”
মিজানুর রহমান আরও বলেন, “পরবর্তীতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আবারও এখানে আসবে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরও কথা বলবে।”
মিয়ানমার প্রতিনিধি দল আসার পর প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “মংডু শহরে প্রচুর রোহিঙ্গা আছে। আমি যতটুকু তথ্য নিলাম, সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা ব্যবসা করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না এমনটি জানিয়েছেন তারা।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে। কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখানে ফেরত পাঠানো যাবে না।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সেনা অভিযান এবং রাখাইন রাজ্যের গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম সময়সীমা ঠিক হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে ঘোষণা দেওয়ায় সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট উদ্যোগ নিলেও বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সর্বশেষ তৃতীয়বারের মতো সম্ভব্য প্রত্যাবাসনের এই কার্যক্রম চলমান।