পরিবার রেখেই ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2021.05.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
পরিবার রেখেই ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা ভাসানচর যাবার জন্য শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌবাহিনীর জাহাজে উঠছেন একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[এপি]

কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গার মধ্যে অর্ধশতাধিক দ্বীপ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন সেখানকার শরণার্থী নেতারা, তবে পুলিশের মতে সংখ্যাটি আরো কম এবং পালাতে গিয়ে ধরাও পড়েছেন কয়েকজন। 

গত ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচর স্থানান্তর শুরু হওয়ার পর এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে পৌঁছান। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে সব রোহিঙ্গাই সেখানে স্বেচ্ছায় গেছেন। 

কিন্তু এর মধ্যেই গত কয়েক মাসে সেখান থেকে “৫০-৬০ জন রোহিঙ্গা পালিয়েছে,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি গুচ্ছগ্রামের ‘ফোকাল’ (সমন্বয়ক) রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ সোহেল।

একই তথ্য দেন ভাসানচরে অন্য এক গুচ্ছগ্রামের নেতা মোহাম্মদ নূর ইসলাম। রোহিঙ্গা নেতারা জানান, পলাতকদের সবাই পুরুষ, যাদের পরিবার চরেই বসবাস করছে। 

তবে ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহে আলমের মতে পলাকতকদের সংখ্যা আরো অনেক কম।

তিনি বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত এই চর থেকে ২০-২২ জনের মতো রোহিঙ্গা পালানোর খবর রয়েছে আমাদের কাছে।”

ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও সেখানে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং নির্যাতনের অভিযোগ তুলে গত ২৭ এপ্রিল বিবৃতি দিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। 

তবে এসব অভিযোগ তখন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। 

পালানোর চেষ্টা হয় ‘প্রায়ই’

স্বেচ্ছায় যাওয়া অনেক রোহিঙ্গাই ভাসানচর থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন বলে বেনারকে জানান সেখানকার রোহিঙ্গা নেতারা। সর্বশেষ বুধবার দ্বীপটি থেকে পালানোর চেষ্টাকালে চারজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান তাঁরা। 

“ভাসানচরে থেকে রোহিঙ্গারা প্রায়ই পালানোর চেষ্টা করে,” স্বীকার করে ওসি মাহে আলম জানান, তাঁদের এমন অনেক চেষ্টাই পুলিশ আটকে দিয়েছে। 

ভাসানচর ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালানোর বিষয়ে অবগত জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, তাঁদের সাথে সমন্বয় করে এটা ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।” 

স্বেচ্ছায় ভাসানচর গিয়ে রোহিঙ্গারা কেন সেখান থেকে পালাচ্ছে সে বিষয়ে কর্মকর্তারা কোনো কারণ না জানালেও অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীরের মতে, দ্বীপটিতে শরণার্থী স্থানান্তর বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে “দূরদর্শিতার অভাব ছিল” বলেই এমন ঘটছে। 

তাঁর মতে, সরকার নিজে দায়িত্বে রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নিয়ে গেছে, ফলে এখন সেখান থেকে কেউ পালিয়ে গেলে তার দায়টাও সরকারের ওপরই বর্তাবে।

দ্বীপ ছেড়ে পালানোর সংখ্যা যাই হউক না কেন, এর “কারণ খতিয়ে দেখা উচিত,” বলে মনে করেন তিনি।

দীর্ঘ দিন থেকেই রাখাইন থেকে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবণতা ও ঐতিহ্য রয়েছে বলে বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।

ভাসানচরের চারদিকের সমুদ্র পালানোর ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের কাছে “কোনো সমস্যাই না” মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা ঠেকাতে নজরদারি বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। 

000_8ZR4VP.jpg
নৌবাহিনীর জাহাজে করে ভাসানচরের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছেড়ে যাচ্ছেন এক দল রোহিঙ্গা। ২৯ জানুয়ারি ২০২১। [এএফপি]

পরিবার রেখেই পালাচ্ছেন রোহিঙ্গারা

গত শনিবার চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে আটক ভাসানচরের তিন রোহিঙ্গা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন, সাগরে তিনঘণ্টা সাঁতার কেটে সন্দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি জেলেরা তাঁদের দেখতে পেয়ে নৌকায় তোলেন। 

“জেলেরা তাদের সাগরে সাঁতরাতে দেখে এগিয়ে যায় এবং জানতে পারে তারা ভাসানচর থেকে পালিয়ে এসেছে,” বুধবার বেনারকে বলেন সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বশির আহমেদ খান। 

জেলেরা ওই তিন রোহিঙ্গাকে ট্রলারে তুলে নিয়ে এসে সন্দ্বীপের মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদে সোপর্দ করে জানিয়ে ওসি বলেন, “কক্সবাজার থেকে তারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে গিয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।” 

তাঁদের বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সম্পর্কিত আইনে মামলা দিয়ে গত রবিবার আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাঁদের কারাগারে পাঠান বলে জানান ওসি। 

গত ডিসেম্বরে স্বামীর সাথে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে যান আসমিদা বেগম (১৯)। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ রফিক ১৭ দিন আগে চর ছেড়ে পালিয়েছেন বলে বুধবার বেনারকে জানান তিনি। 

“সেদিন সেহরি খেয়ে বের হওয়ার পর আর ফিরে আসেনি,” জানিয়ে আসমিদা বলেন, “দুই দিন আগে ফোন করে জানিয়েছে এখন বান্দরবানের আলীকদমে রয়েছে।” 

তিন দিন আগে ভাসানচর থেকে পালানো আবদুল সালামের স্ত্রী রশিদা বেগম বেনারকে বলেন, “সন্ধ্যায় মাছ ধরতে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি সে। বুধবার ফোনে জানিয়েছে, এখন ঢাকায় আছে।” 

“আমাদের পাশের ঘরের একজনও কিছুদিন আগে এভাবে পালিয়ে গেছে। এরপর থেকেই পালানোর চেষ্টা করছিল আমার স্বামী,” বলেন রশিদা। 

মাস তিনেক আগে কুতুপালংয়ের হাকিমপাড়া থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়া বিশটি পরিবারের একটির এক পুরুষ সদস্য সম্প্রতি পালিয়ে কক্সবাজার ফিরে এসেছেন বলে বেনারকে জানান ওই শিবিরের শরণার্থী নেতা মোহাম্মদ হামিদ। 

ফিরে আসা ওই রোহিঙ্গার নামপরিচয় প্রকাশ না করে তিনি বলেন, “প্রথমে সাঁতরে, পরে জেলেদের নৌযানে করে পালিয়ে আসার কথা জানিয়েছে সে।” 

“যদি সম্ভব হতো পরিবারকেও সাথে নিয়ে আসত, এমনটাই সে আমাদের বলেছে,” জানিয়ে ওই রোহিঙ্গার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িতে মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। সবাইকে একপ্রকার বন্দির মতোই থাকতে হচ্ছে।”

তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপর “খুব বেশি কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টি সত্য নয়,” বলে দাবি করেন ভাসানচর থানার ওসি মাহে আলম। 

তিনি বলেন, “করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করতে মানা করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে তারা কোনো প্রয়োজনে এক ‘ক্লাস্টার’ (গুচ্ছগ্রাম) থেকে অন্য ক্লাস্টারে যেতে পারছে না।” 

তবে বিশ্লেষক আসিফ মুনীরের মতে, ভাসানচরে যদি একজন রোহিঙ্গারও নিজেকে ‘বন্দি’ মনে হয় তবে তার কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার দায় সরকারের। 

ভাসানচরে এবার প্রথমবারের মতো ঈদ উদযাপন করবেন প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা।

এ উপলক্ষে চরে শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ জামাত আয়োজনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন আরআরআরসি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।