রোহিঙ্গাদের সহায়তা: প্রত্যাশা ছিল বিলিয়ন ডলার, মিলেছে এক-তৃতীয়াংশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.05.18
ঢাকা
রোহিঙ্গাদের সহায়তা: প্রত্যাশা ছিল বিলিয়ন ডলার, মিলেছে এক-তৃতীয়াংশ কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশু। ৫ এপ্রিল ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে বসবাসকারী আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং কক্সবাজারের পাঁচ লাখ স্থানীয়দের সহায়তায় আগামী এক বছরের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তার আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এর বিপরীতে দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা মিলেছে ৩৪০ মিলিয়ন ডলার। 

মঙ্গলবার জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) সভায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ইউএনএইচসিআর এর প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডিসহ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার প্রধান, দাতা এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। 

রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য এটি চতুর্থ জেআরপি জানিয়ে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ফিলিপ্পো গ্রান্ডি জানান, ২০২১ সালের জন্য মোট ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, তার বিপরীতে মিলেছে ৩৪০ মিলিয়ন ডলার।

তবে এই সহায়তার মধ্যে ২০৬ মিলিয়ন নতুন ও আগের প্রতিশ্রুত ১৩৪ মিলিয়ন ডলার জানিয়ে গ্রান্ডি বলেন, এই অর্থ মোট চাহিদার শতকরা ৩৬ ভাগ।

তবে অন্য দাতারা শীঘ্রই তাঁদের অনুদান ঘোষণা করবে বলেও জানান গ্রান্ডি।

প্রসঙ্গত, গত বছরের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার জেআরপি চাহিদার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে ৬০ ভাগ।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, জেআরপির সকল কর্মসূচি রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত সরকারি নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

এই জেআরপি বাংলাদেশ সরকারের যৌথভাবে তৈরি ও প্রস্তাব করেছে ১৩৪টি সহায়তা সংস্থা ও সহযোগী এনজিও। 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর হিসাবে ১৩ লাখ মানুষের প্রয়োজন মাথায় রেখে আগামী এক বছরের জন্য ৯৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়। 

এর মধ্যে টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বসবাসকারী আট লাখ ৮৯ হাজার রোহিঙ্গা এবং চার লাখ ৭২ হাজার স্থানীয় জনগণকে লক্ষ্য রেখে এই অর্থ চেয়েছিল ইউএনএইচসিআর। 

তবে ভাসানচরে বসবাসকারী প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গার প্রয়োজন এখানে আনা হয়নি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় আশ্রয় নেয়।

তাদের আশ্রয়ের জন্য কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় শিবির নির্মাণ করে সরকার। গত কয়েকবছর ধরে সেখানেই মানবেতর জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের খাবার ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদার জন্য কোনো অর্থ খরচ করে না। শরণার্থীদের এই সকল খরচ আসে বিশ্বের বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর কাছ থেকে অনুদান হিসাবে। এই অর্থ খরচ করে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা। 

কক্সবাজার জেলায় চাপ কমাতে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য বিরাট আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নিতে চায় সরকার।

গত বছর ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ১৯ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে সরিয়ে নিয়েছে সরকার। তবে এই জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো খরচ রাখা হয়নি। 

জেআরপি সভার পর এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের জন্য রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। 

রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে রোহিঙ্গারা মর্যাদার সাথে স্বেচ্ছায় তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে চায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। 

তিনি বলেন, জেআরপিসহ সকল আন্তর্জাতিক উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের টেকসই ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

প্রতিমন্ত্রী আশা করেন, জাতিসংঘ ও সংস্থা সমূহ অচিরেই ভাসানচরে কাজ শুরু করবে।

জেআরপি সভার প্রথম দিনে ৩৪০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া ‘কম নয়’ মন্তব্য করে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশকে বিভিন্ন খাতে অর্থ দিতে হচ্ছে। সেকারণে হয়তো আপাতত স্বল্প অনুদান পাওয়া গেছে।

তাঁর মতে, “অন্যান্য দাতারা আরও অনুদান ঘোষণা করবে। কারণ তারা সময়ে সময়ে ব্যয়ের বিষয়টি পর্যালোচনা করে।” 

মিয়ানমার সরকার এখন “বিভিন্ন জাতিগত সংঘাতে” জড়িয়ে পড়ায় এই সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের খুব একটা সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি। 

“তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক দিক আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেটি হলো, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট সম্প্রতি বলেছে তারা রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলবে। এটি একটি বড় দিক বলা চলে,” বলেন হুমায়ূন কবির। 

সর্বোচ্চ সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের

বরাবরের মতো এবারও জেআরপিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সর্বোচ্চ সহায়তা, ১৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 

এই সাহায্যসহ ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জন্য এক দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিলো যুক্তরাষ্ট্র।

যার মধ্যে এক দশমিক এক বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে কর্মসূচিতে।

শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ সহায়তাকারী দেশ।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে জানিয়ে মে মাসের শুরুতে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারের সাথে এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন শরণার্থী পরিকল্পনার আওতায় কিছু রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে নেবার আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। 

যুক্তরাষ্ট্রে কিছু রোহিঙ্গাকে নেবার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না সে বিষয়ে বেনারের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী নীতিমালাটি স্থায়ী বসতির প্রয়োজন রয়েছে এমন সকল নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য। 

কোনো ধরনের বৈষম্য এড়াতে, নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডের মানুষকে অগ্রাধিকার না দিয়ে এতে বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রয়োজনের অগ্রাধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হয় বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।