করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি: কক্সবাজারে পাঁচ রোহিঙ্গা শিবিরে লকডাউন
2021.05.21
কক্সবাজার

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় কক্সবাজারে উখিয়া ও টেকনাফের ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি রোহিঙ্গা শিবিরে লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন, এই সময় নিজেদের ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত করতে পারবেন না শরণার্থীরা।
আগামী ৩১ মে পর্যন্ত এই লকডাউন চলাকালে শিবিরে কর্মরত দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর জরুরি নয় এমন কার্যক্রমও “সীমিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে,” বলে শুক্রবার বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. আবু তোহা।
তিনি জানান, এই সময়ে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা যেমন নিজের শিবিরের বাইরে যেতে পারবেন না, তেমনি জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ছাড়া বাইরের কেউ শিবিরে প্রবেশও করতে পারবেন না।
তিনি জানান, সম্প্রতি “সংক্রমণ বাড়ার কারণে” লকডাউন করা শিবিরগুলো হলো, উখিয়ার ২-ডব্লিউ, ৩, ৪, ১৫ এবং টেকনাফের ২৪ নম্বর শিবির।
উখিয়া-টেকনাফের শিবিরগুলো তুলনামূলকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
শিবিরগুলোতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর প্রায় সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। নতুন ও পুরনো মিলে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ঘিঞ্জি রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করছেন প্রায় সাড়ে এগারো লাখ রোহিঙ্গা।
শিবিরে হঠাৎ করে সংক্রমণ বেড়ে গেছে
এ পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার শরণার্থীর নমুনা পরীক্ষা করে ৯০৮ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানান ডা. তোহা। তিনি বলেন এই রোগে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ জন শরণার্থী, এছাড়া বর্তমানে আড়াইশো’র বেশি শরণার্থী রয়েছেন আইসোলেশনে।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ শুরু হবার পর এ পর্যন্ত সাত লাখ ৮৬ হাজারের বেশি আক্রান্ত ও ১২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটলেও গত এক বছরে এগারো লাখের বেশি শরণার্থীর ভেতর এই রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ছিল খুবই কম।
কিন্তু গত বিশ দিন ধরে তা হঠাৎ করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে জানিয়ে ডা. তোহা বলেন, “আক্রান্ত ৯০৮ রোহিঙ্গার মধ্যে মে মাসের প্রথম ২০ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১২ জন।”
এর মধ্যে বুধ ও বৃহস্পতিবার প্রতিদিন ৪৫ জন করে শনাক্ত হয়েছেন বলেও জানান তিনি, যা শরণার্থী শিবিরে এক দিনে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
শরণার্থী শিবিরের বাইরে এ পর্যন্ত কক্সবাজারের ৮ হাজার ৫৯৮ জন স্থানীয় মানুষ আক্রান্ত ও ৯৩ জন করোনাভাইরাসে মারা গেছেন বলেও জানান ডা. তোহা।
তবে শরণার্থীদের মোট সংখ্যার তুলনায় আক্রান্তের হার এখনো কম বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।
তিনি বলেন, “বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে বসবাস করছে। এ সংখ্যা অনুযায়ী আক্রান্তের হার বেশি নয়।”
তবে ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরগুলোতে সংক্রমণ কমাতে এই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, লকডাউন বাস্তবায়নে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে কাজ করছেন।
এদিকে শরণার্থীর সংখ্যার তুলনায় রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে পরীক্ষার জন্য নমুনা কম আসছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা অনুপম বড়ুয়া।
নমুনার সংখ্যা বাড়লে আক্রান্তের হার আরও বাড়বে জানিয়ে ডা. অনুপম বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করতে হবে। পাশাপাশি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কর্মীদেরও বেশ সজাগ থাকতে হবে।”
‘সচেতনতা বেড়েছে’
কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখা যায়, সংক্রমণ বাড়লেও বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মানেন না। তবে সম্প্রতি সেখানে অনেকেই মাস্ক পরছেন।
“এটা সত্য যে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা স্বাস্থ্যবিধি মানে না,” বেনারকে বলেন উখিয়ার ৪ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসরত নুরুল আলম।
তবে ঘুমধুম নো ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদের মতে, “প্রথম দিকে অবহেলা করলেও এখন রোহিঙ্গাদের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। অনেক মাস্কও পরছে।”
এদিকে মার্চের শেষ দিক থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পরিকল্পনা থাকেলও টিকার অভাবে তা শুরু করা যাচ্ছে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান।
তবে সরকার, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় শিবিরগুলোতে করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে কেনা এবং দেশটি থেকে উপহার হিসেব পাওয়া ৩৩ লাখ ডোজ যুক্তরাজ্য-সুইডেন উদ্ভাবিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকার মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে শুরু হয় করোনাভাইরাসের গণটিকাদান কর্মসূচি।
কিন্তু চুক্তির মোট তিন কোটি ডোজের মধ্যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭০ লাখ টিকা সরবরাহের পর আর কোনো চালান পাঠায়নি সেরাম।
টিকার সরবরাহ না থাকায় নতুনদের টিকাদান বন্ধ করে শুধু প্রথম ডোজ নেয়া লোকজনকে বর্তমানে টিকাটির দ্বিতীয় ডোজ দিচ্ছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে টিকার কোর্স শেষ করেছেন ৩৯ লাখ ৩০ হাজারের কিছু বেশি মানুষ। অন্যদিকে প্রথম ডোজ নিয়েছেন প্রায় ৫৮ লাখ ২০ হাজার।
ফলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার টিকার নতুন চালান না আসলে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে ১৩ লাখের বেশি মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা।
চীনের আরো ছয় লাখ টিকা উপহার
বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে আরো ছয় লাখ ডোজ টিকা উপহার দেবার ঘোষণা দিয়েছে চীন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে ফোন করে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই কথা জানিয়েছেন বলে শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় চীনের দূতাবাস থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এর আগে গত ১২ মে চীন থেকে বাংলাদেশকে ৫ লাখ টিকা ডোজ টিকা উপহার হিসেবে আসার নয় দিনের মাথায় চীন দ্বিতীয় দফা উপহারের ঘোষণা দিলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাত লাখ, ৮৬ হাজার ৬৯৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৩১০ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৫ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩৪ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।