আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে হাল ছাড়েনি: জাতিসংঘ প্রতিনিধি

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2021.05.26
কক্সবাজার ও ঢাকা
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে হাল ছাড়েনি: জাতিসংঘ প্রতিনিধি কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় রোহিঙ্গা কিশোরদের সাথে কথা বলছেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ভলকান বজকির। ২৬ মে ২০২১।
[বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হাল ছেড়ে দেয়নি বলে বুধবার জানিয়েছেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) সভাপতি বোলকান বজকির। তিনি শরণার্থীদের বলেন- “আমরা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা ভুলে যাইনি।” 

“আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রোহিঙ্গাদের একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,” শরণার্থীদের সাথে আলাপকালে বলেন তিনি। 

দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসে মঙ্গলবার বোলকান বজকির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বুধবার তিনি সফর করেন কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবির।

এদিকে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং তাঁদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের চেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন জাতিসংঘের ওই কর্মকর্তা। 

সরকারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসু দ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারসহ নিরাপদে স্বদেশে ফিরতে জাতিসংঘের প্রতি কক্সবাজারের শরণার্থীরা আহ্বান জানালে তিনি তাঁদের আশ্বস্ত করেন।”

তিনি জানান, “এই আলোচনায় বিভিন্ন শিবিরের চল্লিশ জন রোহিঙ্গা নেতা অংশ নেন।” 

‘চূড়ান্ত লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া’

শরণার্থীদের সাথে দেখা করার পর এক টুইটে বোলকান বজকির বলেন, “আমরা প্রায়ই ইউএনজিএ-তে রোহিঙ্গাদের কথা বলি, কিন্তু আমি আজ তাঁদের সাথেই কথা বলেছি।”

রোহিঙ্গা শিবিরে যাদের সাথে সাক্ষাত করেছেন, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ফিরে তাঁদের গল্পগুলো সবাইকে জানাবেন—এ কথা উল্লেখ করে ইউএনজিএ সভাপতি আরো বলেন, “সাধারণ পরিষদ রোহিঙ্গাদের কথা ভোলেনি।”

এর আগে বৈঠকে রোহিঙ্গা নেতাদের তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে সম্মানের সাথে স্বদেশে প্রত্যাবাসনে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে জাতিসংঘ। এ নিয়ে সাধারণ অধিবেশনেও আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”

“রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এখনো চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া,” যোগ করেন তিনি।

“তাঁকে বলেছি, নাগরিকত্ব, অধিকার এবং মর্যাদাসহ শান্তিপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই আমরা,” বেনারকে বলেন বৈঠকে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা মাহমুদুল্লাহ।

শুধুমাত্র জাতিসংঘের আশ্বাস পেলেই মিয়ানমারে ফিরবেন বলে ইউএনজিএ সভাপতিকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

“আমরা বলেছি, বর্তমানে যারা মিয়ানমারে আইডিপি (ইন্টারনাল ডিসপ্লেসড পারসন) ক্যাম্পে আছে, তাঁদের সব অধিকার নিশ্চিত করে দেখালে আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবো,” বেনারকে বলেন মো. রফিক নামে আরেক রোহিঙ্গা নেতা।

রোহিঙ্গাদের সাথে আলাপকালে ইউএনজিএ সভাপতি উল্লেখ করেন, বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইনে আনুমানিক ছয় লক্ষ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা রয়েছে, যাদের মধ্যে এক লাখ ৪৪ হাজার রয়েছে ২১টি ডিসপ্লেসমেন্ট ক্যাম্পে।

নারী প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেওয়া আফরোজা খানম বেনারকে বলেন, “আমি আমার জীবনে তিনবার শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। ভবিষ্যতে আর আসতে চাই না। সে জন্য জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি, আমাদের প্রত্যাবাসনটা যেন টেকসই হয়।”

বৈঠকে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা মো. হোসেন বেনারকে জানান, বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা শিবিরে রাখাইনের চেয়ে ভালো থাকার কথা উল্লেখ করলেও তাঁরা জানিয়েছেন, সব রোহিঙ্গারাই মিয়ানমারে ফিরতে চায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আজ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় দিয়ে তিনি (ইউএনজিএ সভাপতি) যেভাবে ক্যাম্পে গিয়েছেন এবং রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন, তার একটি ভালো দিক হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ফোরামগুলোতে এই বিষয়টি আবার আলোচিত হবে।”

তিনি বলেন, “কোভিড পরিস্থিতির কারণে আড়ালে চলে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুটিকে পুনরায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে নিয়ে এলেন তিনি।” 

তবে এখনই খুব আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইতিপূর্বেও পৃথিবী যখন এ জাতীয় সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, জাতিসংঘ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।”

তাঁর মতে, “রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে যে কূটনৈতিক জটিলতা আছে, তা বিবেচনা করে খুব সহসাই এই সমস্যা সমাধান হবে বলে মনে হয় না।”

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) ২০২০ সালের আদেশের কথা উল্লেখ করে বজকির বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যা ঠেকাতে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হবে। মিয়ানমারের ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী অস্থিতিশীলতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

বজকির মনে করেন, সেখানকার সামরিক বাহিনীর উচিত জনগণের ইচ্ছাকে সমর্থন জানানো।

রাখাইনের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘের বিশেষ দলকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহবান জানান বোলকান বজকির। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় তিনি বাংলাদেশ সরকার এবং কক্সবাজারের স্থানীয় নাগরিকদের প্রশংসা করেন।

ইউএনজিএ সভাপতি বালুখালী ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে ২২ মার্চের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্প এবং ক্ষতিগ্রস্ত তুর্কি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।

তাঁর সাথে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব (পশ্চিম) শাব্বির আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াতসহ জাতিসংঘের স্থানীয় কর্মকর্তারা।

বোলকান বজকিরের আগে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছিলেন মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ। এছাড়া ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ও অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।