ভাসানচর যেতে রাজি করাতে রোহিঙ্গাদের অর্থ ও নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল: রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.05.27
ঢাকা
ভাসানচর যেতে রাজি করাতে রোহিঙ্গাদের অর্থ ও নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল: রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ টিউব ওয়েল থেকে পানি তুলছেন ভাসানচরে বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা নারী। ৩০ ডিসেম্বর ২০২০। [বিশেষ ছবি, বেনারনিউজ]
[বিশেষ ছবি, বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে রাজি করাতে অর্থ ও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ দেখানো হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ।

“ফেডিং হিউম্যানিজম” অর্থাৎ “হারিয়ে যাওয়া মানবতা” শিরোনামে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাসানচরে গেলে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত রোহিঙ্গাদেরও অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।

ভাসানচরকে একটি ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসাবে উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভাসানচরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে শরণার্থীদের পরিষ্কার ধারণা দেয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত শরণার্থীরা সেখানে ‘স্বেচ্ছায়’ যাচ্ছেন তা বিবেচনা করার সুযোগ নেই। 

দ্বীপটির বাসযোগ্যতা সম্পর্কে জাতিসংঘের মূল্যায়নের আগে পর্যন্ত সেখানে স্থানান্তর স্থগিত রাখার আহ্বান জানায় প্রতিবেদন। এছাড়া উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে ফেলতেও সরকারে প্রতি আহ্বান জানায় সংস্থাটি। 

সরকারের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও রোহিঙ্গারা বলছেন, তাঁদের যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভাসানচর থেকে শরণার্থীরা পালিয়ে যাচ্ছেন। 

অভিযোগ প্রত্যাখ্যান বাংলাদেশের

রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের সবগুলো অভিযোগই “ভিত্তিহীন ও মিথ্যা” বলে প্রত্যাখ্যান করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন। 

তিনি বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে গেলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হবে—এই ধরনের কথা পুরোটাই মিথ্যা। আমরা কেন মিয়ানমারের মানুষদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেবো?”

“বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের জনসংখ্যার কোনো ঘাটতি নেই,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।”

ফৌজদারি অভিযোগ রয়েছে এমন রোহিঙ্গারা ভাসানচর গেলে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে এই কথাও “সম্পূর্ণ মিথ্যা,” উল্লেখ করে দেলোয়ার হোসেন বলেন, “ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগের সাথে ভাসানচরে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ফৌজদারি অপরাধে দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি যেখানেই থাকুক না কেন তার বিচার হবে।” 

রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগগুলোর উৎস সম্পর্কে জানতে বেনারের পক্ষ থেকে প্রতিবেদক ড্যানিয়েল পি. সুলিভানের সাথে যোগাযোগ করা হলে নিরাপত্তাজনিত কারণে তথ্যদাতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। 

“তথ্যগুলো আমরা বিশ্বস্ত সূত্র থেকেই পেয়েছি, যারা তথ্যগুলো শরণার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছেন,” জানিয়ে বৃহস্পতিবার সুলিভান বেনারকে বলেন, “এর আগে ২০১৯ সালে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে আমি নিজেও রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে শুনেছি যে, তাঁরা ভাসানচর যেতে রাজি হলে অর্থ ও বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেয়া হবে বলে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।” 

ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্বীপটি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানানো হয়নি বলে রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দেলোয়ার হোসেন বলেন, “যেসকল রোহিঙ্গা ভাসানচর গেছেন তাঁরা সবাই সবকিছু জেনে স্বেচ্ছায় সেখানে গেছেন। এ ব্যাপারে তাঁদের সকল প্রকার তথ্য প্রদান করা হয়েছে।” 

কক্সবাজারের শিবিরগুলোর ওপর চাপ কমাতে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরিত করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নীতি হলো: আমরা কাউকে ভাসানচরে যেতে জোর করব না, অথবা কোনো কিছু প্রতিশ্রুতি দেবো না।”

উখিয়া ও টেকনাফে শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণেরও সমালোচনা করেছে রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল। তবে দেলোয়ার হোসেনের মতে, “রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই” কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে।

“কাঁটাতার না থাকায় আগে শিবির থেকে মানুষদের অপহরণ করে নিয়ে যেত অপরাধীরা,” বলেন তিনি। 

রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া সংগঠনের সদস্যদের বাংলাদেশের ভিসা দেয়া হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে দেলোয়ার হোসেন বলেন, অনেক বিদেশি বেসরকারি সংস্থার লোকেরা “কূটনৈতিক সুবিধা চান,” যা তাঁদের পাবার কথা নয়। “আবার অনেকক্ষেত্রে, ভিসা আবেদনকারীরা বলতে পারেন না, তাঁরা কেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাবেন।”

এসব কারণে আবেদনকারীর যুক্তিতে “সন্তুষ্ট না হলে” ভিসা অফিসার আবেদন বাতিল করতেই পারেন বলে জানান তিনি। 

ভাসানচরে বর্তমানে থাকা সাড়ে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা “খুব সুন্দর জীবনযাপন করছেন। তাঁরা দ্বীপের যেকোনো স্থানে যেতে পারেন,” বলে বেনারকে জানান ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর রাশেদ সাত্তার।

শরণার্থীরা সেখানে কৃষিকাজ শুরু করে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। 

ভাসানচরকে “রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই সুন্দর ও নিরাপদ আবাসস্থল,” হিসেবে আখ্যায়িত করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব মো. মোহসিন বেনারকে বলেন, “ঢাকাস্থ দূতাবাসের কূটনীতিকরা এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল ভাসানচর সফর করেছেন। তাঁরা সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।”

“রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচর গেছেন এবং তাঁরা সেখানে ভালো আছেন,” বলেন সচিব মোহসিন।

প্রসঙ্গত, গত মার্চে জাতিসংঘের এক প্রতিনিধি দল ভাসানচর পরিদর্শন করে আসলেও এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

এদিকে গত সপ্তাহে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সাথে “ভাসানচরের অবস্থা সম্পর্কে” একটি বৈঠক হয়েছে জানিয়ে সচিব মোহসিন বলেন, “সেখানকার ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন তাঁরা। আশা করি, ভাসানচরে জাতিসংঘ তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।” 

রোহিঙ্গাদের অসন্তোষ

ভাসানচরের সুবিধা নিয়ে বেনারের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গারা। তাঁদেরকে টাকা পয়সা দেবার কথা বলা হয়েছিল বলে জানালেও নাগরিকত্ব অথবা অপরাধ থেকে দায়মুক্তির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন বলে বেনারকে জানান।

মাছ শিকার, গরু-মহিষ পালন ও চাষাবাদ করার সুযোগ মিলবে—এমন আশ্বাসে ভাসানচরে আসার কথা জানিয়ে সেখানকার রোহিঙ্গা নেতা নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “শুধু মাছ ধরার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সুযোগে কিছু রোহিঙ্গা পালিয়ে যাওয়ায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।”

ভাসানচরে আনার সময় সব রোহিঙ্গাকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের প্রতি মাসে কিছু খরচের টাকা দেওয়া হবে—এমনটাও তখন বলা হয়েছিল। কিন্তু এখানে আসার পর আর কোনো টাকা পাইনি।”

কক্সবাজারের চেয়ে বাড়তি ত্রাণ ও ভালো চিকিৎসা সেবার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল, যা তাঁরা ভাসানচরে পাননি উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, এসব কারণেই স্বেচ্ছায় ভাসানচরে এসেও অনেকে পালাচ্ছে।

বেকারত্বের কারণে কর্মক্ষম অনেকে পালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে আরেক রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ সোহেল বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গা যুবকদের মধ্যেই পালানোর প্রবণতা বেশি। কারণ তারা কক্সবাজারের শিবিরে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কাজ করে আয় করতে পেরেছে, এখানে তা পারছে না।” 

“ভাসানচরে আনার আগে তাদের গার্মেন্টসে চাকরি, মাছ শিকার ও কৃষি জমিতে তাদের কাজ করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল,” বলেন তিনি।

ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গার মধ্যে অর্ধশতাধিক দ্বীপ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে চলতি মাসের মাঝামাঝি বেনারকে জানিয়েছেন সেখানকার শরণার্থী নেতারা। তবে পলাকতকদের সংখ্যা “২০-২২ জনের মতো” বলে বেনারের কাছে দাবি করেছিলেন ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহে আলম। 

বেনারের পক্ষ থেকে রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের এই প্রতিবেদনের ব্যাপারে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মন্তব্য চাইলেও সংস্থাটি কোনো মন্তব্য করেনি। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি নামক জঙ্গি সংগঠন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়ে বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করার পর সমগ্র সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে সেদেশের সরকার ও বৌদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী। 

প্রাণ ভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তাঁদের আশ্রয় মেলে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ। সেখানে বর্তমানে বসবাস করছেন প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। 

তাঁদের স্বেচ্ছা, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসন করতে সেই বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে মিয়ানমার সরকার। তবে প্রায় চার বছর পার হয়ে গেলেও একজন রোহিঙ্গাকেও সেদেশে ফেরত পাঠানো যায়নি।

অন্যদিকে রোহিঙ্গারাও তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে না দিলে সেদেশে ফিরে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।

এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের ভালো আবাসন ব্যবস্থা দিতে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নোয়াখালী জেলাধীন ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলেছে সরকার। গত বছর ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে অবস্থান করছে। 

জাতিসংঘ ও কূটনীতিকরা রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে, এই চর বসবাসের জন্য নিরাপদ নয়। 

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম ও কক্সবাজার থেকে আব্দুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।