দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ ৪ দফা দাবিতে রোহিঙ্গাদের ‘ঘরে ফেরা প্রচার’
2023.06.08
কক্সবাজার ও ঢাকা
চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে বৃহস্পতিবার ‘ঘরে ফেরা প্রচার’ শুরু করেছে কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একাংশ।
একইদিন জেনেভা থেকে দেওয়া বিবৃতিতে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রু বলেছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযোগী অবস্থায় নেই।
এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বৃহস্পতিবার আহ্বান জানান জাতিসংঘের এই বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার।
এদিকে আগের ঘোষণা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির থেকে ‘গো হোম ক্যাম্পেইন’ শুরু হয়। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গারা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা, নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
সরেজমিন দেখা যায়, বৃহস্পতিবারের সমাবেশ উপলক্ষে টেকনাফের লেদা, জাদিমুড়া ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সকাল থেকে শত শত লোকজন জড়ো হতে শুরু করেন। সমাবেশে পুরুষের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী, শিশুরাও যোগ দেন।
এছাড়া কুতুপালং, বালুখালী, লম্বাশিয়ায়ও এ ধরনের সমাবেশ হয়েছে। সেসব স্থানে পোস্টার ও প্ল্যাকার্ডে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তোলেন।
এই সমাবেশে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য পুলিশ সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিল জানিয়ে টেকনাফের ১৬ এপিবিএনের পুলিশ সুপার মো. জামাল পাশা বলেন, “কয়েকটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে কর্মসূচি পালন করেছে। সেটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।”
‘আমরা আর বাংলাদেশে থাকতে চাই না’
দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা দাবি করে টেকনাফের জাদিমুড়া শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা বজলুল রহমান বলেন, “আমরা আর বাংলাদেশে থাকতে চাই না। দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, চলাচলের স্বাধীনতাসহ নিজ গ্রামে ভিটেমাটি ফেরত দিলে এই মুহূর্তে চলে যাব।”
সমাবেশ শেষে কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা মো. হোসাইন বেনারকে বলেন, “এখানে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে ক্যাম্পে বন্দি জীবনে আছি। আমরা দ্রুত মিয়ানমারে নিজ বসত ভিটায় ফিরে যেতে চাই। এর জন্য আলোচনা চলছে। একটি মহল প্রত্যাবাসন বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে।”
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “আমরা আর শরণার্থী জীবন চাই না। সামনের দিনগুলোতে আমরাও আমাদের জন্মভূমি আরাকানে (রাখাইনে) জীবনযাপন করতে চাই। বিশ্ব সম্প্রদায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যাপারে যেন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেন।”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়।
আগে থেকেই এখানে ছিল আরও কয়েক লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা।
প্রায় ছয় বছর পার হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। দেওয়া হয়নি নিরাপত্তার আশ্বাস।
কয়েক মাস আগে হঠাৎ করেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তৎপর হয়ে ওঠে মিয়ানমার ও তার মিত্র দেশ চীন। কয়েক বছর আগে নেওয়া পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে আগ্রহের কথা জানায় মিয়ানমার।
এই উদ্দেশ্যে মার্চ মাসে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল টেকনাফ সফর করে ৪৮০ পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও প্রত্যাবাসনের জন্য মনোনীত করে।
রাখাইনের পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের একটি দল মংডু সফর করে। এরপর আবার মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের দাবি পূরণ না হলে মিয়ানমার যেতে রাজি নন।
যদিও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথমে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হলে পরে ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়বে।
বাংলাদেশ সরকার এই বছরের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠাতে চায় বলে বেনারকে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গত মাসে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ফারুক খান। এই প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য চীনা ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের আহ্বান জানান।
সরকারি আগ্রহ থাকলেও প্রত্যাবাসনের কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ ঠিক হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মিজানুর রহমান।
প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইন উপযোগী অবস্থায় নেই
বৃহস্পতিবার জেনেভা থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রু বলেন, বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায় যে বাংলাদেশ সরকার বল প্রয়োগ করে এবং ছলনামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযোগী অবস্থায় নেই। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনাকারী বাহিনীর নেতৃত্ব যিনি দিয়েছিলেন সেই সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইং সামরিক সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; এই বাহিনী নিরপরাধ বেসামরিক ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছে এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার খর্ব করছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তারিখ উল্লেখ না করলেও প্রাথমিকভাবে ১১৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন। চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরও ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, প্রথম দফায় লোকজনকে পাঠানোর বিষয়টি শিগগির ঘটতে পারে। যারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে, তাদের সরকার গ্রেপ্তারের হুমকি, কাগজপত্র জব্দ ও নানা ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
টম অ্যান্ড্রুস আরও বলেন, শরণার্থীরা ফিরে যেতে রাজি হওয়ার বিনিময়ে তাদের বিপুল অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির খবর প্রকাশ পেয়েছে। এমনও অভিযোগ এসেছে যে প্রতিদিন প্রত্যেক রোহিঙ্গার খাবারের বরাদ্দ যখন কমছে, তখন অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যাবাসনে রাজি হওয়া রোহিঙ্গাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ কোথা থেকে আসবে সেটা স্পষ্ট নয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “জাতিসংঘ পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে নিষেধ করছে—এটি ঠিক আছে। এর বিরোধিতা করার কিছু নেই।”
তিনি বলেন, “মিয়ানমারে এখন গৃহযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের আগেই সেখানে রোহিঙ্গাদের কোনো অধিকার ছিল না। এখন কীভাবে থাকবে! রাখাইনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই প্রত্যাবাসন উপযোগী নয়।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের পাঠানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না। এটি মিয়ানমার এবং চীনের যৌথ উদ্যোগ। পাইলট প্রকল্পের আওতায় পাঠানো হলে এটি রোহিঙ্গা অথবা বাংলাদেশ কারো লাভ হবে না। লাভ হবে মিয়ানমার ও চীনের।”
“রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে চীন সরকার। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার চীনের কাছে বড়ো; বাংলাদেশ নয়। মিয়ানমার যে কাজ করতে পারছে না চীন পরোক্ষভাবে সেটি করছে এবং পাইলট প্রকল্প মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এটি আমাদের বুঝতে হবে,” বলেন তিনি।
তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, “বাংলাদেশের উচিত এসব পাইলট প্রকল্প বাদ দিয়ে সব রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকারসহ টেকসইভাবে সে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।”