শরণার্থী শিবিরে ‘আধিপত্যের লড়াইয়ে’ ছয় মাসে ২৫ রোহিঙ্গা খুন
2024.06.12
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে চলতি বছরে ২৫ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়েছে।
রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছেন, শিবিরে প্রায় এক ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। তবে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়ায় মধুরছড়া চার নম্বর ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় সৈয়দ আমিন (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হন।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম বেনারকে বলেন, “সৈয়দ আমিন আরএসওর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তাঁর ওপর হামলা হয়।”
এর এক দিন আগে সোমবার একই ক্যাম্পে আরও তিনজনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের মতে, তাঁরাও আরএসওর সদস্য ছিলেন। সে সময় আরও সাতজন গুলিবিদ্ধ হন।
বুধবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ঘোনারপাড়া ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ-৪ ব্লকে পুলিশের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আব্দুল মোনাফ (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিআইজি) মো. আমির জাফর বেনারকে জানিয়েছেন, আব্দুল মোনাফ একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং দীর্ঘ দিন পলাতক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা ও অস্ত্রসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
এদিকে শরণার্থী শিবিরে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে জেলা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ টহল জোরদার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান ৮ এপিবিএনের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী।
“এছাড়া ক্যাম্পগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে,” বলেন তিনি।
বাড়ছে সহিংসতা
পুলিশ ও র্যাবের তথ্য মতে, শরণার্থী শিবিরে চাঁদাবাজি ও মাদক চোরাচালানকে ঘিরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে হামলা, সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। এতে চলতি বছরের শুরু থেকে ১১ জুন পর্যন্ত চারজন কমিউনিটি নেতাসহ ২৫ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালে হত্যার শিকার হন ৬৪ জন।
এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ১৩২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। হত্যার শিকার অধিকাংশই ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝি।
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে রোহিঙ্গা মাঝিরা জানান, শিবিরের সব জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারা নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। এখন আর আগের মতো দল বেঁধে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন না তারা। কাউকে টার্গেট করলে সুবিধা মতো সময়ে হামলা করে।
মাঝিরা জানান, “কোনো একটি সশস্ত্র গ্রুপ একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আরেকটি গ্রুপ পাল্টা হামলা করে সেই এলাকার দখল নেওয়ার চেষ্টা করে।
“ক্যাম্পে ফের আরসা-আরএসওর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা বাড়ছে। এছাড়া মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধে অংশ নিতে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পাঠানো নিয়েও এদের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে,” বেনারকে বলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেতা মোহাম্মদ সেলিম।
‘নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের’
একাধিক শিবিরের কয়েকজন নেতা ও সাধারণ রোহিঙ্গা বেনারের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির পক্ষে লড়াই করতে যুবকদের উৎসাহ দিচ্ছে আরএসও। অন্যদিকে যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে আরসা।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীও এমন তথ্য শুনেছেন বলে বেনারকে জানান।
“ক্যাম্পের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা রাতে গ্রামে ঘোরাঘুরি করছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারাও শঙ্কিত,” বলেন তিনি।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতা “আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, “এই গ্রুপগুলো নানা রকম স্বার্থের কারণে বিভক্ত। রাখাইন পরিস্থিতির কারণে এই গ্রুপগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থাকতে পারে।”
তাঁর মতে, “সার্বিক দিক বিবেচনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে নিজেদের করণীয় ঠিক রাখতে হবে এবং অবশ্যই সীমান্তে নজরদারি জোরদার করতে হবে।”
এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন শরণার্থী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।
তিনি বলেন, “রাখাইনে চলমান সহিংসতার কিছু প্রভাব এখানে পড়বে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তাই অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আমাদের বাহিনীগুলোকে বেশি সক্রিয় হতে হবে।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠনগুলো আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড়ো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।”
রাখাইন পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এর আগে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, কক্সবাজার এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী সংগঠন-ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
তিনি জানান, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত হত্যা ও অস্ত্র মামলায় ৯৯৪ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।