ঢাকা থেকেও জন্ম নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন রোহিঙ্গারা
2024.06.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
বাংলাদেশে কতজন রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—উচ্চ আদালত তা জানতে চাওয়ার দুদিন পরেই জানা গেছে ঢাকা থেকেও রোহিঙ্গাদের কয়েকজন অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সরকারিভাবে কক্সবাজার ও নোয়াখালীর ভাসানচরে শিবিরে রাখা হয়েছে, যেখানে তাঁদের চলাচল সীমিত। কিন্তু একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, অনিয়মের মাধ্যমে সারা দেশে অন্তত ১০৯ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশি হিসেবে জন্ম নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪৯ জনই সনদ পেয়েছেন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে।
এ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠির অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
যে সময় ৪৯ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশের জন্ম নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন, সেই সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রোহিঙ্গাদের নামের তালিকা জমা দেওয়ার আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আগামী ৮ আগস্টের মধ্যে সেই তালিকা জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া এবং ভোটার করার অর্থ হলো তাঁদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, যা “খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার” বলে মনে করেন বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বেনারকে বলেন, এ সব বিষয়ে যারা জড়িত, “তাঁদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।”
পুলিশের বিশেষ শাখার চিঠি
স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে গত ২৬ মে পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে চিঠি দিয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। চিঠির সঙ্গে ১০২ জন রোহিঙ্গার নামের তালিকাও সংযুক্ত করা হয়।
তালিকার ওই ব্যক্তিদের কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্টও সংগ্রহ করেছেন জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “তাদের নামের পাশে বর্ণিত বিভিন্ন স্থান থেকে দালাল চক্র, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইত্যাদি ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রতারণামূলকভাবে বাংলাদেশি জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তালিকায় বর্ণিত ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ভুক্ত মিয়ানমারের নাগরিক।”
এর প্রেক্ষিতে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে গত ৫ জুন চিঠি দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া সনদ দেওয়ার সময় দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়।
আইন বহির্ভূতভাবে নিবন্ধিত ওই ৪৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্ম সনদ ইতোমধ্যে সিস্টেম থেকে স্থগিত করা হয়েছে বলেও জানানো হয় চিঠিতে।
রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের বিষয়টি দুই দিন আগে জেনেছেন জানিয়ে বৃহস্পতিবার সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বেনারকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁরা “সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে” জবাব চেয়েছেন।
‘আইন মানা আমাদের দায়িত্ব’
সারা দেশে কতজন রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছেন সেই তালিকা সরবরাহ করার জন্য গত মঙ্গলবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ সংশ্লিষ্টদের আদেশ দেয়।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সিদ্দিক উল্লাহ মিয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত।
আদালত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রেজিস্ট্রারকে আগামী ৮ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে অন্তর্ভুক্ত রোহিঙ্গাদের নামের তালিকা জমা দিতে বলেছে বলে বেনারকে জানান সিদ্দিক উল্লাহ মিয়া।
এর আগে চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের নাম বাদ দিতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত।
“কক্সবাজার জেলায় কতজন রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং কতজন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে সে তথ্য প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে গত ৬ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসক নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দেননি,” বলেন সিদ্দিক।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে এ সংক্রান্ত ১৮টি মামলা দায়ের হয়েছে জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “একটি উপজেলা থেকে ৩৪০ জন রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তথ্য আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি।”
কক্সবাজারের ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থেকে বাদ দিতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন স্থানীয় বাসিন্দা হামিদুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমি বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও এখন পর্যন্ত সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করতে পারিনি কিন্তু টাকার বিনিময়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি এনআইডি করে বাঙালি বনে গেছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
"এসব বিষয় নিয়ে আমি জেলায় সরকারি অনেক কর্মকর্তার দ্বারস্থ হয়েছি কিন্তু তাঁরা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাই আমি হাইকোর্টে এসেছি। আমার চাওয়া হচ্ছে, সব রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হোক," বলেন হামিদুর।
তবে এ বিষয়ে অবগত নন জানিয়ে কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন বেনারকে বলেন, “প্রত্যেক উপজেলায় ভোটার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিশেষ কমিটি রয়েছে। ফলে এখানে রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
এ প্রসঙ্গে আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বেনারকে বলেন, “আমরা যে দেশে আশ্রয় নিয়েছি, সে দেশের আইন মেনে চলা আমাদের দায়িত্ব। যদি কোনো রোহিঙ্গা এ ধরনের কাজ করে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের আইন অনুযায়ী চাইলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।”
এদিকে “কোনোভাবে যাতে রোহিঙ্গারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে, সে জন্য প্রত্যেক উপজেলায় বিশেষ কমিটি সর্তকতার সঙ্গে কাজ করছে,” বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক শাহীন মুহাম্মদ ইমরান।