মিয়ানমারকে চাপ দিতে পারছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, হতাশ রোহিঙ্গারা

জেসমিন পাপড়ি
2019.06.18
ঢাকা
190618_Rohingya_ARSPH_1000.jpg রাখাইনে ফিরে যাবার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না করে কোনো ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালুর বিরুদ্ধে টেকনাফের একটি শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ। ১৫ নভেম্বর ২০১৮। [এএফপি]
[এএফপি]

রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ না করায় হতাশা প্রকাশ করেছে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)।

মঙ্গলবার শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও ত্রাণ কমিশনারের কার্যালয়ে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে এ অভিযোগ করেছে সংগঠনটি। নিজ দেশে ফিরতে আগ্রহের কথা জানিয়ে প্রত্যাবাসনের পথে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের সঙ্গে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ওই সংগঠনের নেতারা।

শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও ত্রাণ কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ে স্মারকলিপিটি দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন এআরএসপিএইচের সভাপতি মুহিব উল্লাহ।

তবে আরআরআরসি কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল কালাম বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর জন্য কোনো স্মারকলিপির আমরা পাইনি। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।”

মুহিব উল্লাহ বলেন, “প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ দেওয়া হয়নি বলে আমরা মনে করি। এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের মতই হতাশ।”

এর আগে গত ৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কক্সবাজারে স্বেচ্ছাসেবা দিতে আসা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা চায় না যে, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক। মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী নয়।

মুহিব উল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের মিথ্যাচার, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধিতা ও মিয়ানমারের প্রতি বহির্বিশ্বের চাপ না থাকার যেসব কথাগুলো বলেছেন, তা সম্পূর্ণ সত্য। এসব কথা তুলে ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকবে রোহিঙ্গারা।

লক্ষ্য হারিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

রোহিঙ্গাদের অধিকার সংগঠন এআরএসপিএইচ’র দেওয়া একটি স্মারকলিপির কপি বেনারের হাতে এসেছে।

সংগঠনটি মনে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে। রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক বিষয়ে জোর দিতে গিয়ে অন্য বিষয়ে নজর দিতে পারছে না তারা।

এআরএসপিএইচ জানায়, মিয়ানমার তার যেসব নাগরিককে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নিতে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ দিচ্ছে না কেন? আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আসলেই রোহিঙ্গাদের চাওয়ার কোনো মূল্য দিতে চায় না। আসলেই তারা রোহিঙ্গাদের কথা শুনছে না।”

বাংলাদেশ আমাদের বাড়ি নয়

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, “আমরা তাদের বারবার বলতে শুনছি, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে থেকে যাবে। এটা কিন্তু আমরা চাই না। বাংলাদেশ আমাদের বাড়ি নয়। আমরা চিরদিন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে থাকতে চাই না।”

রাখাইনে এখনো যে সব রোহিঙ্গার বাড়ি আছে তারা ফিরতে পারছে না কেন প্রশ্ন রেখে এর উত্তরে বলা হয়, “কারণ- মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে ফেরার বিষয়ে দায়িত্ব নিতে চায় না।”

স্মারকলিপিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে অঙ্গীকারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠানোর কথা ‍উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া রাখাইনের ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে উদাত্তভাবে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানায় এআরএসপিএইচ।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, প্রত্যাবাসন সম্পর্কে রোহিঙ্গারা অনেক রকমের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। তাই এক সঙ্গে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

এতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পথে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতাদের যুক্ত না করলে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব প্রক্রিয়া থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এখনো বাইরে রাখা হয়েছে। আলোচনার প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের না নেওয়া হলে কোনো প্রত্যাবাসন হবে না।

বয়োজ্যেষ্ঠদের নির্যাতন করা হচ্ছে: অ্যামনেস্টি

মিয়ানমারের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লাখো বয়োজ্যেষ্ঠ নারী-পুরুষ সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। ভিটেমাটি ছেড়ে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। সেখানেও তাঁরা নানারকম মানবিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

মঙ্গলবার ‘পুরো জীবন পালিয়ে বেড়ানো: মিয়ানমারে বয়োজ্যেষ্ঠদের সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিকার ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলো সেভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না।

প্রতিবেদনটিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, কাচিন, লিসু, রাখাইন, শান ও তা’আং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৫৪ থেকে ৯০ বছর বয়স্ক ১৪৬ জন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারদাতা কয়েকজনের বয়স ৯০ বছরেরও বেশি।

প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়। এর মাঝে একটিতে গত মার্চে রাখাইনে আরাকান আর্মির সাথে সেনাবাহিনীর সংঘাত চলাকালীন ৬৭ বছর বয়সী এক কৃষককে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি।

বলা হয়, সেনাবাহিনী আসার খবরে ওই গ্রামের প্রায় সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালালেও সংঘাতের খবর জানতেন না ওই কৃষক। পিঠমোড়া করে বেঁধে সেনাসদস্যরা ওই কৃষককে কর্মকর্তার সামনে হাজির করলে তাঁদের গ্রামে আরাকান আর্মি এসেছিল কিনা জানতে চাওয়া হয়। কৃষক তাদের কখনো দেখেননি জানালে সাথে সাথে তাঁকে সেনাসদস্যরা মারধর শুরু করেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সংকটবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ম্যাথিউ ওয়েলস বলেন, “দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন বারবার সেনা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শিশু অথবা তরুণদের মতো অনেক বয়োজ্যেষ্ঠও সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানসহ নানা সময়ে বর্বরতার শিকার হয়েছেন।”

“তাঁদের এই অভিজ্ঞতা সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের নিষ্ঠুরতা ও ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালোভাবে তুলে ধরেছে,” বলেন তিনি।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন: ‘পদ্ধতিগত ব্যর্থতা

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ‘পদ্ধতিগত ব্যর্থতার’ প্রমাণ খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, এই ব্যর্থতার কারণেই ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বার্তা সংস্থার এএফপির খবর অনুযায়ী, সোমবার জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হামলার সতর্ক বার্তা উপেক্ষা করার অভিযোগ ওঠে সে দেশে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে মিয়ানমারে জাতিসংঘ কার্যালয়ের ভূমিকার বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন করতে গত ফেব্রুয়ারিতে আদেশ দেন বিশ্ব সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

পদ্ধতিগত ব্যর্থতার কথা বললেও এর সঙ্গে দায়ীদের শনাক্ত করা কঠিন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। নতুন এই প্রতিবেদন বলেছে, “জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী ঘৃণ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়ার সাথে যুক্ত সব পক্ষই যৌথভাবে দায়ী।”

৩৬ পৃষ্ঠার এই নতুন প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন গুয়াতেমালার প্রখ্যাত কূটনীতিক গার্ট রোজেনথাল। রোহিঙ্গা নিপীড়ন ঠেকাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণগুলো সম্পর্কে তিনি লেখেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অতি উৎসাহ একটি কারণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সু চির জনপ্রিয়তাও প্রভাব ফেলেছে এ ক্ষেত্রে।

এই প্রতিবেদনের বিষয়ে সোমবার জানতে চাওয়া হলে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিচ বলেন, মহাসচিব গুতেরেস সুপারিশগুলো গ্রহণ করেছেন এবং জাতিসংঘের কার্যপদ্ধতির উন্নতি করতে সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।