অভ্যন্তরীণ কোন্দল: রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা নেতা খুন
2022.06.23
ঢাকা ও কক্সবাজার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সদস্যদের গুলিতে এবার আরেক আরসা সদস্য নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
বুধবার সন্ধ্যার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্প-১৭ এলাকায় আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও পুলিশের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্মদ হাশিমের সহযোগী বলে পরিচিত মোহাম্মদ শাহ নিহত হন।
রোহিঙ্গা শিবিরে এটি দ্বিতীয় আরসা নেতা নিহতের ঘটনা। এর আগে গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো পুলিশের পক্ষ থেকে মো. সেলিম (৩০) নামে এক আরসা নেতা নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে আরসা সদস্যরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক মো. নাইমুল হক।
তিনি জানান, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সাব-ব্লক ৯৪ এর একটি দোকানের সামনে মোহাম্মদ শাহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা দেবার কিছুক্ষণ পর সঙ্গীদের কয়েকজন তাঁর গলা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে কোনো আরসা নেতার মৃত্যু এটিই প্রথম।
মোহাম্মদ শাহের মৃত্যুর বিষয়ে বৃহস্পতিবার দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এপিবিএন জানিয়েছে, “মোহাম্মদ শাহ তথাকথিত আরসা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শীর্ষ সন্ত্রাসী হাশিমের সহযোগী ছিল। হাশিম অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়ার পর মোহাম্মদ শাহ মিয়ানমারে পালিয়ে যায়।”
এতে বলা হয়, হাশিমের মৃত্যুর পেছনে তার হাত থাকতে পারে, আরসার সদস্যরা এমন সন্দেহ করে আসছিল।
“নিহত মোহাম্মদ শাহ রোহিঙ্গা শিবিরের একজন চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা দুষ্কৃতকারীদের তালিকায় তার নাম শীর্ষে রয়েছে,” বলেন এপিবিএন কমান্ডার নাইমুল হক।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন মিয়ানমার এবং জিরো পয়েন্ট এলাকায় লুকিয়ে থাকার পর কিছুদিন আগে সে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে আসে এবং তখন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে আসছিল।”
তবে নিহতের স্ত্রী সাজেদা বেগম বেনারকে জানিয়েছেন, “বাড়িতে নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাড়ি থেকে বের হয়ে মোহাম্মদ শাহ পাশের দোকানে যান। এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কিছু লোক তাঁকে গুলি করে পালিয়ে যায়।”
পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়
শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে এপিবিএন এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) কামরান হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী শিবিরে কিছু সশস্ত্র রোহিঙ্গার সাথে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
এসময় একটি আমেরিকান রাইফেল, ৪৯১ রাউন্ড গুলি, একটি বিদেশি পিস্তল ও ছয় হাজার ৩০০ পিস ইয়াবাসহ দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
কামরান হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ১৫/২০ জনের একটি রোহিঙ্গা গ্রুপ ক্যাম্প-১৮ থেকে ক্যাম্প-২০ এর দিকে যাওয়ার সময় গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাম্প-১৮ এর বিভিন্ন ব্লকে অবস্থান নেন এপিবিএন সদস্যরা।
রাত ১০টার দিকে ৫/৬ জন লোক ক্যাম্প ২০ এর দিকে আসার সময় এপিবিএন সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করেন। তারা এপিবিএন সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে এপিবিএন সদস্যরা পাল্টা গুলি চালান। এ সময় তারা পালিয়ে যায়।
পরে ঘটনাস্থল থেকে পলিথিনে মোড়ানো যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি রাইফেল এবং ৪৯১ রাউন্ড তাজা গুলি উদ্ধার করা হয় বলে জানান কামরান হোসেন।
শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্প ১৮ থেকে ক্যাম্প ১৫ এর ই/৬ ব্লকে অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদ হোছেন (৩০) ও জাহেদ হোসেনকে (৩০) একটি নাইন এমএম পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি ও ছয় হাজার ৩০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
তিন সপ্তাহে চার খুন
বুধবারের হত্যাকাণ্ডসহ গত তিন সপ্তাহে রোহিঙ্গা শিবিরে মোট চার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
গত ১৫ জুন আরসা সদস্য সেলিম (৩০), ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রাতে রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া গত মাসে খুন হন সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামের দুই রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক।
‘জোর করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা আরসার’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, আরসা মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য বিদেশি গোয়েন্দাদের তৈরি একটি জঙ্গি সংগঠন।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আরসা কোনো কাজ করে না। তাদের আদর্শ সহিংসতা। সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে তারা কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। মুহিব উল্লাহর মতো নেতা যিনি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছিলেন তাঁর প্রতি রোহিঙ্গাদের সমর্থন রয়েছে।”
আব্দুর রশীদ বলেন, “আরসা সদস্যরা শরণার্থী শিবিরে হত্যা, সহিংসতা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে ভয় দেখিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, “এই অবস্থায় সরকারের উচিত হবে, আরসা সদস্যদের নির্মূল করা। তারা যেন শরণার্থী শিবিরে উগ্রবাদী আদর্শ প্রচার না করতে পারে সে বিষয়ে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর একযোগে হামলা চালায় আরসা সদস্যরা।
এই হামলার জবাবে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এতে শত শত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
শরণার্থীদের সাথে আরসা সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল যে, রোহিঙ্গা শিবিরে জঙ্গিদের অস্তিত্ব নেই।
তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতি রয়েছে।
শরণার্থীরা শুরু থেকেই বলে আসছেন বাংলাদেশে শিবিরে আরসার সদস্যরা হত্যা, গুম, ডাকাতি, রাহাজানি, নির্যাতনসহ অবৈধ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সাথে যুক্ত।
আরসায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানো এবং শরণার্থীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে আরসা সদস্যরা, যা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।
ওই তদন্তের পর থেকে অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে এপিবিএন।
পুলিশ জানিয়েছে, শরণার্থী শিবিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আরসা সদস্যরা যুক্ত। এমনকি বর্তমানে তারা পুলিশ সদস্যদের ওপরও হামলা চালাচ্ছে।