ভূমি ধস ও বন্যায় কক্সবাজারে চার শিশুসহ ছয় রোহিঙ্গার মৃত্যু
2021.07.27
কক্সবাজার ও ঢাকা
দুই দিনের ভারী বর্ষায় কক্সবাজারে মোট ছয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃত্যু ঘটেছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত।
সবগুলো মৃত্যুই ঘটেছে উখিয়ার বালুখালীর ১০ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে।
এই পরিস্থিতিতে বালুখালীসহ বিভিন্ন এলাকার দুর্যোগপূর্ণ শিবিরগুলো থেকে দেড় হাজারের বেশি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখনো কয়েকটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।”
বৃষ্টির পানিতে বালুখালী শিবিরের “শতাধিক ঘর ডুবে গেছে,” বলে বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার (এসপি) শিহাব কায়সার খান। তবে রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, মঙ্গলবার পর্যন্ত বালুখালী ও আশপাশের বিভিন্ন শিবিরের পাঁচ শতাধিক শরণার্থী পরিবার আশ্রয় হারিয়েছে।
এদিকে বৃষ্টি ও ভূমি ধসের কারণে শিবিরগুলোতে “মোট কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়,” বেনারকে জানান অতিরিক্ত আরআরআরসি মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন।
“তবে ধারণা করা হচ্ছে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যাটা বেশিই হবে,” বলেন অতিরিক্ত আরআরআরসি।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) অভিমত জানতে চেয়ে সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয় মুখপাত্র হান্না ম্যাকডোনাল্ডকে বেনারের পক্ষ থেকে ইমেইল করে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
গত দুই দিনে পাহাড় ধসে নিহতরা হলেন; দিল বাহার (২৬), আবদুর রহমান (২), আয়েশা সিদ্দিকা (১), দিল বাহার (৪২) ও শফিউল আলম (৯)। দশ বছরের শিশু আবদুর রহমানের মৃত্যু ঘটেছে পানিতে ডুবে। এছাড়া নুর ফাতেমা (১৪) ও জানে আলম (৮) নামের আরো দুই রোহিঙ্গা শিশু ধসের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে।
বালুখালীর রোহিঙ্গার ভয়ে
এর আগে গত মার্চে বালুখালীর এই ১০ নম্বর শিবিরেই অগ্নিকাণ্ডে ১১ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনা উল্লেখ করে সেখানকার রোহিঙ্গা নেতা সুলতান আহমদ বেনারকে বলেন, “একের পর এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে বলে এই শিবিরের সবাই খুব ভয়ে আছে।”
তিনি বলেন, “গত দুই দিনে অনেক পরিবার গৃহহারা হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি তাঁদের স্বজনদের ঘরে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।”
এ ছাড়া শিবিরের শিক্ষাকেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে বেনারকে জানান আরআরআরসি।
“২০১৭ সালের আগস্টে বার্মিজ সেনাদের জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের বন্যা ও ভূমিধসের শিকার হওয়া উচিত নয়,” এ কথা উল্লেখ করে ‘বাংলাদেশ: বন্যা ও ভূমিধসে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ’ শিরোনামে ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এতে রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে দুর্যোগ প্রতিহত করার মতো স্থায়ী অবকাঠামো তৈরির সুযোগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
এরপর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বহুবার এই দাবির পুনরাবৃত্তি করলেও এ ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। সরকারের মতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান সাময়িক। তাঁদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই একমাত্র স্থায়ী সমাধান। তাই রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে স্থায়ী আবাসন কাঠামো তৈরি যুক্তিযুক্ত নয়।
তবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির থেকে এক লাখের মতো রোহিঙ্গাকে অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেবার জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে সরকার নোয়াখালীর দ্বীপ ভাসানচরে আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত সেখানে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বেনারের পক্ষ থেকে দুর্যোগ পরিচালনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ও সচিব মো. মহসিনের বক্তব্য জানতে তাঁদের মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাড়া মেলেনি।
তবে ওই মন্ত্রণালয়ের এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “সব দিক বিবেচনা করেই জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের এই নাগরিকদের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে পোক্ত অবকাঠামো তৈরি করেছে সরকার।”
তাঁর মতে, “ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর চেয়ে নিরাপদে আছে।”
“কক্সবাজারের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরিত হওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা রাখা উচিত,” বলে বেনারকে জানান আরআরআরসি।
পরিণতির কথা চিন্তা করা হয়নি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বেসরকারি সংস্থা ডিজাস্টার অ্যান্ড ডেভলপমেনট অর্গানাইজেশনের (ডিএডিও) প্রধান নির্বাহী ড. মো: ইদ্রিস আলমের মতে, “উখিয়া ও টেকনাফের যেসব স্থানে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো গড়ে উঠেছে তার প্রায় পুরোটাই পাহাড়ি এলাকা। পরিস্থিতির কারণে সেখানে পরিকল্পিতভাবে কিছু সুযোগ ছিল না।”
সরেজমিন গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “স্থাপনা তৈরির জন্য ৩০ ডিগ্রির চেয়ে কম ‘অ্যাঙ্গেলে’ পাহাড় কাটার নিয়ম থাকলেও শিবিরগুলোতে ৯০ ডিগ্রী ‘এ্যাঙ্গেলে’-ও অনেক পাহাড় কাটা হয়েছে।”
“সেখানে যেভাবে পাহাড়গুলো কেটে বসতি ও রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, তার সবকিছুই অপরিকল্পিতভাবে পরিণতির কথা চিন্তা না করেই করা হয়েছে,” বলেন ড. মো: ইদ্রিস।
রোহিঙ্গা শিবির এলাকার কোন কোন স্থান ধসপ্রবণ তা “বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিহ্নিত করা আছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “গবেষকদের চিহ্নিত প্রতিটি স্থান যদি থেকে মানুষ সরিয়ে ফেলা না হয়, আগামীতেও সেখানে পাহাড় ধসে আরো প্রাণ হারানোর ঘটনা আমাদের দেখতে হবে।”
রোহিঙ্গাদের কারণেই কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার “ন্যাচারাল ড্রেনেজ সিস্টেম’ নষ্ট হয়ে গেছে,” মন্তব্য করে ড. ইদ্রিস বলেন, “বর্তমানে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ রয়েছে সেখানে।”
ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো থেকে সরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমিউনিটির নেতাদের মাধ্যমে শরণার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করা হলেও অনেকেই সেসবে গুরুত্ব দেন না জানিয়ে আরআরআরসি বেনারকে বলেন, “আমরা জোর করে কাউকে সরাতে পারি না।”
এর আগে গত ৫ জুন পাহাড় ধসে উখিয়ায় রহিম উল্লাহ (৩৫) ও টেকনাফে নুর হাসিনা (২০) নামের দুই রোহিঙ্গা মারা যান।
কক্সবাজারে পাহাড় ধসে রোহিঙ্গা ছাড়া বাংলাদেশিদেরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। মঙ্গলবার পাহাড় ধসে টেকনাফে রকিম আলী (৫৫) ও এর আগে ৬ জুন মহেশখালীতে সুমাইয়া বেগম নামের আড়াই বছরের এক শিশু এবং ১৯ জুন মোহাম্মদ জুনায়েদ নামের ১১ বছরের এক বাংলাদেশি শিশুর মৃত্যু হয়।
গত দুই দশকে চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসে পাঁচ শতাধিক মানুষ মারা গেছেন বলে জানান ড. ইদ্রিস।
ডুবে গেছে শূন্যরেখার শিবিরও
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া শূন্যরেখার রোহিঙ্গা শিবিরও পানিতে তলিয়ে গেছে।
“গোটা আশ্রয় শিবির কোমর পানিতে তলিয়ে রয়েছে। নিচু এলাকার ঘরবাড়ি একেবারে ডুবে যাওয়ায় সেখানে বসবাসরত এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে গেছে,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন ওই শিবিরের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ।
সেখানে খাবার পানির সংকটও শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।