শরণার্থী শিবিরে দুই রোহিঙ্গা মাঝি খুন
2022.08.10
কক্সবাজাৱ
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে দুই মাঝিকে গুলি করে হত্যা করেছে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে।
উখিয়ার জামতলি ১৫ নম্বর শিবিরের সি-৯ ব্লকের পাহাড়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে বেনারকে জানান ৮ এপিবিএন এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন।
নিহতরা হলেন, ১৫ নম্বর শিবিরের সি-৯ ব্লকের হেড মাঝি আবু তালেব (৪০) এবং সি/৯ সাব ব্লকের মাঝি সৈয়দ হোসেন (৩৫)।
এ নিয়ে গত জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তিন মাঝি এবং দুই আরসা নেতাসহ নয়জন নিহত হয়েছেন। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কে আছেন রোহিঙ্গারা।
কামরান হোসেন জানান, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ওই ক্যাম্পে রাতে স্বেচ্ছায় পাহারা চালু ছিল। পাহারার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বণ্টন শেষে মোবাইলে কথা বলার জন্য ওই পাহাড়ে উঠেছিলেন আবু তালেব ও সৈয়দ হোসেন। এ সময় ৮-১০ জন সন্ত্রাসী তাঁদের গুলি করে পালিয়ে যায়।
“নিহত দুইজনই রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ছিলেন। অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে তাঁরা পুলিশকে সহযোগিতা করতেন। আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, এ কারণে দুর্বৃত্তরা তাদের টার্গেট করেছে।" বলেন কামরান হোসেন।
তিনি বলেন, এ ছাড়াও শিবিরে মাঝি নিয়োগ করা নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুই মাঝিকে হত্যা করা হয়েছে বলেও পাওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
হত্যাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে এখন পর্যন্ত “নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না,” জানিয়ে তিনি বলেন “তবে এটি যে পরিকল্পিত এবং টার্গেট কিলিং তাতে সন্দেহ নেই।”
হত্যাকারীদের ধরতে ক্যাম্পে ব্লক রেইড পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
নিহত দুই রোহিঙ্গা মাঝির মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী। এ বিষয়ে মামলাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।
দুইমাসে ৯ খুন
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমার ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) দুই নেতা, তিন মাঝিসহ অন্তত নয়জন খুন হয়েছেন।
মঙ্গলবার দুই মাঝিকে হত্যা ছাড়াও গত ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মো. ইব্রাহীম (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হন।
এর আগে ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ হন হাবিব উল্লাহ (২০) নামে এক রোহিঙ্গা, ৪ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে নুরুল আমিন (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে দিনের বেলায় গুলি করে আরসা সন্ত্রাসীরা।
গত ২২ জুন মিয়ানমার ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য আরসা নেতা মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
একই মাসে (১০জুন) কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
এ ছাড়া গত মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামের দুই স্বেচ্ছাসেবক।
আতঙ্কে রোহিঙ্গারা
শিবিরের অনেক নেতাই পুলিশকে অপরাধী ও আরসা সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে সহায়তা করে বলে বেনারকে জানান বালুখালীর রোহিঙ্গা নেতা মো. কামাল হোসেন।
“কিন্তু কারাগার থেকে বের হওয়ার পর অপরাধীরা তথ্যদাতাদের চিহ্নিত করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে,” জানিয়ে কামাল বলেন, “এসব কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্য দিতে সাহস পায় না। ”
তিনি বলেন, “পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা রাতের পাহারা ব্যবস্থা শুরুর পর থেকে অপরাধীরা বেকায়দায় পড়েছে। প্রায়ই আরসা সদস্যরা শিবির নেতাদের ফোনে হুমকি দেয়। আমরা পুলিশকে হুমকির বিষয়ে অবহিত করি।”
“যদিও পুলিশ আমাদের সাহায্য করছে, তবুও একের পর এক হত্যার ঘটনায় আমরা খুব ভয়ের মধ্যে আছি,” যোগ করেন এই রোহিঙ্গা নেতা।
এদিকে সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবিরে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেগুলো সবই “টার্গেট কিলিং এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড” জানান মো. কামরান হোসেন।
তিনি বলেন, “দুর্বৃত্তরা যখন কাউকে টার্গেট করে তখন কোন পথে ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে, কে হত্যাকাণ্ড ঘটাবে, কোন পথে পালাবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামে। এ কারণে টার্গেট কিলিং ঠেকানো আসলেই কঠিন।”
“দুই মাঝিকেও আগে থেকেই টার্গেট করে এবং পূর্ব পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, তারা এক পথ দিয়ে ঘটনাস্থলে গেছে, আবার হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়েছে আরেটি সরু পাহাড়ি পথ দিয়ে,” জানান কামরান।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এপিবিএন এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.রবিউল ইসলামও বেনারকে বলেন, আধিপত্য বিস্তার, গ্রুপিং, স্বার্থের দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে পরিকল্পিতভাবে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় সেগুলো ঠেকানো আসলেই কঠিন।
তবে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ এবং ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসার ছয় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যার পর ক্যাম্পের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি নানাভাবে অপরাধ দমনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।