মিয়ানমারে তিন বছর আগের সহিংসতার ক্ষত তাড়িয়ে বেড়ায় রোহিঙ্গা শিশুদের

রোজেন জেরিন ও সুনীল বড়ুয়া
2020.08.24
ওয়াশিংটন ডিসি ও কক্সবাজার
200824-BD-Rohingya-kids-1000.JPG কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের সামনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে কয়েকজন রোহিঙ্গা শিশু। ১০ ডিসেম্বর ২০১৭।
[রয়টার্স]

তিন বছর আগে ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর তাণ্ডব চালায় তখন আরত উল্লাহ’র বয়স ছিল ১৪ বছর।

সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আরত উল্লাহ বেনারকে বলে, “রাত তিনটার দিকে ওরা আমাদের বাড়িতে গুলি করতে শুরু করে। এ অবস্থায় আমরা দৌড়াতে শুরু করি। পথে পথে দেখতে পাই ওদের মারপিট, জ্বালাও–পোড়াও আর গোলাগুলি। কারো বাবা মারা গেছে, কারো ভাই–বোন, কারো বা মা।”

“আমার এক ভাই ও এক দুলা ভাই মারা গেছে। এর পর যখন সেখানে আর থাকতে পারছিলাম না, তখন অন্যদের সাথে বাংলাদেশে চলে আসি,” জানায় আরত।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযানের ফলে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন।

ওইসব রোহিঙ্গাদের সাথে সহিংসতার স্মৃতি নিয়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় আরতের মতো কয়েক লাখ শিশু। যারা এখনো সহিংসতার স্মৃতি ভুলতে পারেনি।

“আর্মির সঙ্গে স্থানীয় বৌদ্ধরাও সেদিন মারামারিতে যোগ দেয়। আরতের চোখের সামনে ওর দুলাভাই এবং চাচাতো ভাইকে গুলি করেছে,” বেনারকে বলেন আরত উল্লাহ’র মা আনোয়ারা বেগম (৪০)।

“গোলাগুলি এবং খুন দেখার কারণে আরত বাংলাদেশে আসার পর অসুস্থ হয়ে যায়। ও ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠত। পরে ক্যাম্পের ক্লিনিকে চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়,” বলেন তিনি।

“আমি এখনো ভুলতে পারি না, ওরা আমার এক দুলাভাইকে আমার চোখের সামনে গুলি করেছে,” বেনারকে জানায় রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা আরেক রোহিঙ্গা শিশু মোহাম্মদ আয়াছ। ২০১৭ সালে আয়াছের বয়স ছিল ১১ বছর।

ঘটনার সময় মাত্র ছয় বছর বয়সে নিজের চোখের সামনে আত্মীয়দের হত্যাকাণ্ড দেখা আরেক রোহিঙ্গা শিশু তসলিমা আক্তার বেনারকে জানায় “তারা আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার দাদাকে মেরেছে, আমার মামাকে মেরেছে, আমার চাচাকেও মেরেছে।”

রাখাইন রাজ্যে সীমান্তরক্ষীদের চৌকিতে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় তিন বছর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতায় প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন।

বর্তমানে তাঁরা গাদাগাদি করে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন।

টেকনাফের বাহারছড়া শরণার্থী শিবিরে নিজের ঘরের সামনে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে নয় বছরের রোহিঙ্গা শিশু তসলিমা আকতার। ১৬ আগস্ট ২০২০।
টেকনাফের বাহারছড়া শরণার্থী শিবিরে নিজের ঘরের সামনে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে নয় বছরের রোহিঙ্গা শিশু তসলিমা আকতার। ১৬ আগস্ট ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]
জাতিসংঘ ও সেবাসংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, মিয়ানমারের সহিংসতার দুঃসহ স্মৃতি থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের বের হয়ে আসার জন্য এখনো প্রচুর সহায়তা প্রয়োজন।

“মিয়ানমার থেকে পালানোর সময় তীব্র মানসিক আঘাতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বাস্তুচ্যুতির যে রূঢ় অভিজ্ঞতা রোহিঙ্গা শিশুরা সহ্য করেছে, তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে,” বেনারকে বলেন সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার অ্যাথেনা রায়বার্ন।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কয়েক শতাব্দি ধরে বসবাস করলেও দেশটিতে তাঁরা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নন। বরং মিয়ানমার তাঁদেরকে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করে থাকে।

একই সাথে কয়েক দশক ধরেই তাঁরা দেশটিতে নিপীড়নের শিকার। যার ফলে সত্তর দশক থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটতে থাকে, যার মধ্যে ২০১৭’র আগস্টের পর ছিল এক সাথে কয়েক লাখ শরণার্থীর অনুপ্রবেশ।

জাতিসংঘের একটি সত্য-সন্ধানী মিশন তদন্তের পর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে।

এদিকে করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধি নিষেধের কারণে গত এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সেবা কার্যক্রম অনেকটা সীমিত হয়ে পড়ায় রোহিঙ্গা শিশুরা বিভিন্ন ধরনের দৈহিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে জানান শরণার্থী শিবিরের সেবাকর্মীরা।

 

 

শরণার্থীদের অর্ধেকই শিশু

রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত জাতিসংঘ ও এনজিও সেবাসংস্থাদের তথ্যমতে কক্সবাজারের ৩৪টি শিবিরে বসবাসরত আট লাখ ৫৫ হাজার শরণার্থীর ৫০ শতাংশের বেশির বয়স আঠারোর নিচে, যাদের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।

“যদিও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবুও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় কাঠামোগত মনো-সামাজিক সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি,” বলা হয় সেবাসংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।

সেবা কর্মীরা জানিয়েছেন, মনোসামাজিক সহায়তা হলো ভুক্তভোগীদের মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক প্রয়োজনগুলো একই সঙ্গে দেখার কার্যক্রম। বাচ্চাদের যন্ত্রণা লাঘবে এটা দরকার।

ইউনিসেফের কক্সবাজার কার্যালয়ের প্রধান এজাতুল্লাহ মজিদ এক ইমেইল বার্তায় বেনারকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সামাজিক কাঠামোর ওপর নির্ভরতার প্রয়োজন বেড়েছে।”

জাতিসংঘ এবং এনজিওর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেনা নির্যাতনের মনোযন্ত্রণা মোকাবিলায় এবং শরণার্থীশিবিরের বিরূপ পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শিশুরা গত তিন বছরে চূড়ান্ত সামর্থ্য দেখালেও এখনো তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন রয়েছে।

এদিকে সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা রায়বার্ন বেনারকে জানান, “সাম্প্রতিক এক জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মানসিক সমস্যার জন্য আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো; মৌলিক চাহিদা পূরণে অপ্রতুলতা, অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাধীন চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা।”

শরণার্থী শিবিরে কাজ করা মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, যেসব শিশু তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর গণহত্যা দেখেছে, তাদের পর্যাপ্ত মনো-সামাজিক সহায়তা দিতে না পারলে তারা আগ্রাসী চরিত্রের হয়ে যেতে পারে।

সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল আমীন জালালী বেনারকে জানান, “স্বাস্থ্যকর্মীরা ২০১৭ সালে রাখাইনে সহিংসতার ফলে বেদনাকাতর ৪০ হাজার শিশুর একটি তালিকা করেছিলেন যাদের মধ্যে অন্তত ৮ হাজার শিশু রয়েছে যারা বাবা এবং মা উভয়কেই হারিয়েছে।”

“কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ১৩ হাজার শিশু তাদের বেদনাকাতর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এবং বাকি ২৭ হাজার শিশু এখনো সামলে ওঠার লড়াইয়ে আছে,” বলেছেন জালালী।

জাতিসংঘ এবং এনজিওগুলো শরণার্থী শিবিরের ভেতর শিশুদের খেলাধুলা এবং বিনোদনের যে আয়োজন করেছে, এটা তার সুফল বলে তিনি মনে করেন।

রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হলেও তাঁদের অনেকেই নিজের শিশুদের সেবায় নিয়োজিত হয়েছে।

“রোহিঙ্গারা নিজেরাই অনেক তৎপর। শিবিরের ভেতর সেবা কার্যক্রমে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মূল শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে,” বলেছেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী সেবার পরিচালক ফ্রেডরিক খ্রিস্টফার।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শিশুদের জন্য নতুন সংকট তৈরি করেছে। কিছু সেবাকর্মী কক্সবাজার ছেড়ে চলে গেছেন, ফলে শিশুদের সেবা কার্যক্রম কমাতে হয়েছে।

কক্সবাজারের বালুখালি শরণার্থী শিবিরে দড়ি দিয়ে বানানো দোলনাতে দোল খাচ্ছে দুইটি রোহিঙ্গা শিশু। ১৬ নভেম্বর ২০১৮। ফ্রান্সের ডক্টরস উইদাউট বর্ডার পরিচালিত কক্সবাজারের গোয়ালমারা মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ফেরদৌলি পোরসেল ইমেইল বার্তায় বেনারকে জানানা, “করোনাজনিত স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগ দিতে গিয়ে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কমাতে হয়েছে।”

করোনাভাইরাসের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে অন্যান্য মানবিক সেবা সংগঠনগুলোও কার্যক্রম কমানোর কথা জানিয়েছে।

“করোনা সংক্রমণ এড়াতে এপ্রিলের শুরু থেকে সেবা কার্যক্রম শুধুমাত্র জরুরি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমীত করা হয়েছে। শিশু এবং বালিকাদের জন্য পরিচালিত শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছে,” বলেছেন সেভ দ্য চিলড্রেনের রয়বার্ন।

“শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুরা নির্যাতন, শোষণ, শারীরিক ও যৌন সহিংসতা, এবং অবহেলার মধ্যে থাকে। তারা মানব পাচারের পাশাপাশি শিশুশ্রম এবং বাল্য বিবাহে বাধ্য হওয়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে। এগুলো তাদের মানসিক সুস্থতায় সংকট তৈরি করতে পারে,” বলেন রায়বার্ন।

শিশুদের ওপর এ ধরনের সহিংসতা তাদের ঘরে এবং বৃহত্তর রোহিঙ্গা সমাজেই ঘটে,” বলেন ওয়ার্ল্ড ভিশনের ক্রিস্টোফার।

তিনি বলেন, “তাই কোভিড–১৯ বিধিনিষেধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ রাখা জরুরি। তা না হলে তারা আরও বেশি নির্যাতনের কবলে পড়বে,” বলেন তিনি।

সোমবারে প্রকাশিত সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের এক প্রতিবেদন মতে, ২০‌১৭ সালের আগস্টের পর বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৭৬ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করেছে।

জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান।
জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান।
[সূত্র: ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ]

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী ও ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার অন্যতম সম্পাদক রোজেন জেরিন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।