নীরবে গেলো রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সহিংসতার তৃতীয় বর্ষপূর্তি
2020.08.25
ঢাকা ও কক্সবাজার
আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২০। ইস্টার্ন সময় বিকেল ৪:২০
আন্তর্জাতিক আগ্রহ সরে গেলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নাও হতে পারে। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে না দিলে এবং গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার না করলে তাঁরা রাখাইন ফিরবেন না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বুধবার বেনারকে বলেন, তিন বছর পার হয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকার আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না। রাখাইন পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়নি। তিনি জানান, করোনাভাইরাস মহামারি এবং নভেম্বরে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের কারণে দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য চীন, ভারত ও জাপানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যহত রাখতে হবে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু হলে এক সাথে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন।
এর আগে থেকেই বাংলাদেশে বাস করছিলেন আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
২৫ আগস্টকে সামনে রেখে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি ভাসানচরে পূনর্বাসনের প্রস্তুতি চলছে। এই সংকটে আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ, পর্যটন ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ কমে গেলে ১১ লাখ অতিরিক্ত মানুষের বোঝা বাংলাদেশ কীভাবে বইবে? এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরিত করতে নোয়াখালীর দ্বীপ ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে সরকার অবকাঠামো তৈরি করে। তবে জাতিসংঘসহ রোহিঙ্গাদের আপত্তির কারণে সেখানে এখন পর্যন্ত কার্যত রোহিঙ্গা স্থানান্তর সম্ভব হয়নি।
গত মে মাসে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ভিড়তে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর দুই দফায় প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দেয় সরকার।
ভাসানচরের বসবাস উপযোগিতা দেখতে সম্প্রতি সেখানে কক্সবাজার থেকে একদল রোহিঙ্গা প্রতিনিধিকে নিয়ে যাবার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের আশা, প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে এসে রোহিঙ্গাদের বোঝালে তাঁরা সেখানে যেতে রাজি হবেন।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের অনাগ্রহ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত তিন লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে। কিন্তু মিয়ানমার মাত্র তিন হাজার রোহিঙ্গাকে তাঁদের নাগরিক বলে স্বীকার করেছে।
তিনি বলেন, “চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় তাঁদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু দুদফায় চেষ্টার পরও রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে রাজি হয়নি। কারণ তাঁরা মনে করেন রাখাইনে এই মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নতির দায়িত্ব মিয়ানামারের। তারা সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি।”
তিনি বলেন, “প্রত্যাবাসন শুধু বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে না। মিয়ানমারকে রাজি হতে হবে; রোহিঙ্গাদের রাজি হতে হবে। প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে রাজি করানো যায়নি।
আব্দুল মোমেন বলেন, “দ্বিপক্ষীয় সভায় মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো কিছু পরিস্কার করে বলা হয় না। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ রয়েছে। নভেম্বরে তাদের দেশে নির্বাচন। তারা নির্বাচনের আগে আলোচনায় বসতে চায় না।”
করোনাভাইরাসের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শ্লথ হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন মিয়ানমার কর্মকর্তারা।
“কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমাদের কার্যক্রমে কিছু সীমাবদ্ধতা এসেছে। তবে প্রয়োজনীয় যা কিছু করার তা করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন,” বেনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন মিয়ানমারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের উপপরিচালক থুরেইন তুন।
ঘরে বসেই ২৫ আগস্ট পালন
গত বছর কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার সমাবেশের মাধ্যমে ২৫ আগস্ট পালিত হলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার দিনটি পালিত হয়েছে কোনো ধরনের সমাবেশ ছাড়াই।
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মো. নূর বেনারকে বলেন, “আমরা নীরবে ঘরে বসেই রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস কাটিয়েছি। কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ বা কর্মসূচি রোহিঙ্গাদের ছিল না। তবে আমরা দাবি-দাওয়া এবং অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের অবস্থানে অটল।”
তিনি বলেন, “আমরা শুরু থেকে বলে আসছি, এটা আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ মিয়ানমার। অতীতে সে দেশে আমাদের ওপর অনেক জুলুম–নির্যাতন হয়েছে। তবুও আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। তবে আমাদের সকল অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।”
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সাধারণ সম্পাদক মো. জুবায়ের বেনারকে বলেন, “সারাদিন আমি আমার পরিবারের সঙ্গে ঘরেই ছিলাম। আমার মতো সকল রোহিঙ্গা আজ ঘরে বসেই রোহিঙ্গা নির্যাতনের ‘নীরব প্রতিবাদ’ জানিয়েছে। আমরা মনে করি, এটি আমাদের জন্য শোকের দিন।”
তিনি বলেন, “মিয়ানমারে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমরা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানাই।”
জুবায়ের বলেন, “মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের কারণে রোহিঙ্গাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো দিনও মুছে যাবে না। তবু আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। কারণ এটি আমাদের জন্মমাটি নয়।”
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহাবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই দিনটি পার হয়েছে।
এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “করোনা মহামারির কারণে সব কিছুই স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। সে জন্য আমরা আগে থেকেই তাঁদের বলে দিয়েছি এবার গণজমায়েত বা জনসমাগম করা যাবে না।”
প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, “সরকারের প্রধান এবং প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যাবাসন।”
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কূটনৈতিকভাবেই সমাধান হবে। মিয়ানমার তাঁদের নিতে চাইবে না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”
“মিয়ানমারকে রাজি করাতে বাংলাদেশের উচিত চীন, ভারত, জাপানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা,” মনে করেন হুমায়ূন কবির।
এদিকে সোমবার ঢাকায় এক ওয়েবিনার বক্তব্যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহয়তা হিসেবে তাঁর দেশ এখন পর্যন্ত ৯৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে, যা একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ সহায়তা।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে এই সংকটের কারণ হিসাবে বার্মায় (মিয়ানমার) সংঘটিত অমানবিকতার রূপ প্রত্যক্ষ করে আপনার হৃদয় ভেঙ্গে যাবে। আবার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে সাড়া এবং সহায়তাকারী দেশগুলোকে দেখে আপনি অনুপ্রাণিতও বোধ করবেন।”
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তৃতীয় বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
চলমান সংকট
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হাতে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হলে দেশটির সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে। তাদের সাথে যোগ দেয় রোহিঙ্গাদের কাছে মগ হিসাবে পরিচিত উগ্র সশস্ত্র বৌদ্ধ গ্রুপ।
প্রাণভয়ে বাংলাদেশের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা। সরকারি হিসাবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
আগে থেকে বসবাসকারী রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন।
রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্টকে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসাবে পালন করে থাকেন।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেই চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে ‘স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে’ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ। দফায় দফায় সভা করার পরও কোনও সমাধান মেলেনি।
ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তালিকা মিয়ানমারের কাছে দেয়ার কথা।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাব আসলে তাতে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। ফলে এই সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘও কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
২০২০ সালে দুটি আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রসঙ্গে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমার সকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করছে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে জানায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
এর আগে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে সুরক্ষার জন্য দেশটির প্রতি আদেশ জারি করে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)।
তবে গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের নেত্রী আং সান সূচি তাঁর দেশে রোহিঙ্গাদের ওপর কোনো ধরনের গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি দাবি করে জানান, রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন না করে কিছু ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তাঁর দেশের বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে।
আপডেট: প্রতিবেদনটিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য যোগ করা হয়েছে।