কক্সবাজারে শিশুরা পালন করল ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’ দিবস

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2021.08.25
ঢাকা ও কক্সবাজার
কক্সবাজারে শিশুরা পালন করল ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’ দিবস গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শিবিরের জড়ো হয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা সংগঠিত ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করেন শরণার্থী নারীরা। ২৫ আগস্ট ২০২১।
[বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবিরে আকস্মিক জড়ো হয়ে ন্যায় বিচারের দাবি জানিয়েছে কয়েকশ রোহিঙ্গা শিশু। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার চার বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিচার চায় তারা।  

উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে মাত্র ১৫ মিনিটের মতো অবস্থানকালে নিজ দেশে ফিরতে চেয়ে ‘বিচার চাই’, ‘বিচার চাই’ বলেও শ্লোগান দেয় এসব শিশু।  

“২৫ আগস্ট গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ক্যাম্পে দিবসটি পালনের অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তবে সকালে ক্যাম্পে হঠাৎ কয়েকশ শিশু ন্যায় বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় তারা রোহিঙ্গা গণহত্যার ন্যায় বিচারের পাশাপাশি নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বলে শ্লোগান দেয়,” বেনারকে বলেন উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ রফিক। 

যদিও শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ও উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্প-ইন-চার্জ মেরিনা আফরোজা বেনারকে বলেন, “আমরা সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেছি। এই সময়ে ২৫ আগস্ট উপলক্ষে কোনো ধরনের মিছিল, সমাবেশ হয়নি।” 

শিশুদের পাশাপাশি খানিকটা গোপনীয়তার সাথে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ছোট পরিসরে ও বিক্ষিপ্তভাবে রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস পালন করেন।  

এ সময় তাঁদের হাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নিহত স্বজনদের ছবিসংবলিত পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন শিবিরের মসজিদে জোহরের নামাজের পর স্মরণসভা হয়। এ সময় নিহত রোহিঙ্গাদের আত্মার মুক্তি ও শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। 

“গণজমায়েত ও বিক্ষোভ সমাবেশের ওপর সরকারের কঠোর নজরদারি আছে। তারপরও মিয়ানমারের প্রতি ঘৃণা জানাতে গোপনে এই কর্মসূচি আয়োজন করা হয়,” বেনারকে বলেন উখিয়ার রোহিঙ্গা আমির হোসেন (৫০)। 

তিনি বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম সীমিত আকারে হলেও গণহত্যা দিবসের সভা-সমাবেশ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানাতে। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে আশ্রয়শিবিরগুলোতে আগে থেকেই বিধিনিষেধ জারি করা আছে। গত বছরও রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস পালন করতে পারিনি।” 

এ বিষয়ে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “করোনা মহামারির কারণে রোহিঙ্গা শিবিরের সকল কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চলছে। জনসমাগম হয় এমন সভা–সমাবেশ সেখানে করতে দেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে শিবিরগুলোতে বর্ষপূর্তির কর্মসূচি ছিল না।” 

এর আগে ২০১৯ সালে ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে গণহত্যাবিরোধী মহাসমাবেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জড়ো হয়, যা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, এরপর থেকেই আশ্রয়শিবিরের ভেতরে ২৫ আগস্ট সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে কক্সবাজার অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। সেবছর দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। পরের বছর ২০১৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা দিনটিকে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। এর আগে থেকে বসবাসকারী রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন।  

১০ রোহিঙ্গা সংগঠনের বিবৃতি

রোহিঙ্গা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগের আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে কাজ করতেও বলা হয় এই সরকারকে।  

বুধবার গণহত্যা দিবস উপলক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে এ আহবান জানিয়েছে রোহিঙ্গাদের ১০টি সংগঠন।  

সংগঠনগুলোর নেতারা বলেন, “২৫ আগস্ট গণহত্যা দিবস পালন করার উদ্দেশ্য হলো, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানতে পারে, সেদিন রাখাইনে কী ঘটেছিল। দিবসটি পালনের মাধ্যমে আমরা মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতা, গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তাঁদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।”

“মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের গ্রাম ধ্বংস করেছে। এ ছাড়া তারা আমাদের লোকজনকে হত্যা ও ধর্ষণ করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এই হামলার ফলে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে,” বিবৃতিতে বলা হয়।

“আমরা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের গণহত্যা মামলা সমর্থন করি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর সহযোগিতা চাই। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাই,” বলা হয় ওই বিবৃতিতে। 

মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রোহিঙ্গা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দিতে আহবান জানানো হয় বিবৃতিতে। এতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘকে আরো তৎপর হওয়ার আহবান জানানো হয়।  

রোহিঙ্গা নেতারা বিবৃতিতে বলেন, “চার বছর পার হলেও আমরা মাতৃভূমিতে ফিরতে পারিনি। ন্যায়বিচার ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করব।” 

বিবৃতি দেওয়া সংগঠনগুলো হচ্ছে- চ্যাম্পিয়নস অব চেঞ্জ, এডুকেশন অ্যান্ড উইজডম ডেভেলপমেন্ট ফর রোহিঙ্গা উইমেন, রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি, রোহিঙ্গা উইমেন এডুকেশন ইনিশিয়েটিভ, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফোর লিগ্যাল অ্যাকশন, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ইউনিটি টিম, ভয়েজ অব রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়ন, রোহিঙ্গা উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক। 

স্থানীয়দের দাবি দ্রুত প্রত্যাবাসন 

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবিতে বুধবার কক্সবাজার শহরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি। 

এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, “মাত্র চার বছরেই রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয়দের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।” 

“রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার চার বছরের মধ্যে মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেছে। এদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে উখিয়া-টেকনাফে স্থানীয়দের বসবাস করা কঠিন হবে,” বলেন তিনি। 

উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা যখন এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তখন স্থানীয়রা তাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে। অথচ রোহিঙ্গাদের হাতেই ইতিমধ্যে অনেক স্থানীয় জনগোষ্ঠী হত্যার শিকার হয়েছে। হামলার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।