রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের নতুন ভাষা ‘তারানা গীত’
2023.08.25
ঢাকা ও কক্সবাজার
মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে গানে গানে প্রতিবাদ ও দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে শুক্রবার কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে দেশত্যাগের ষষ্ঠ বার্ষিকী উদযাপন করলেন রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়নে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে আবেগ ও দুঃখের গান ‘তারানা গীত’।
“চলো চলো আমরা সবাই আরকানে ফিরে যাই” বা “রোহিঙ্গারা আর রিফিউজি হিসেবে দিন কাটাতে চায় না”—এমন গান গাইতে গাইতে মিয়ানমারে গণহত্যার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে কাঁদছিলেন অনেকে।
কক্সবাজারে আশ্রিত শরণার্থীদের সাম্প্রতিক প্রায় সব বড়ো কর্মসূচিতে রোহিঙ্গা ভাষায় রচিত এই গানের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে।
শত শত রোহিঙ্গা সমস্বরে তারানা গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছেন উখিয়া ও টেকনাফের শিবিরগুলোতে।
“তারানা গান মনে করিয়ে দেয়, রোহিঙ্গাদেরও একটি দেশ আছে। সেখান থেকে তারা বিতাড়িত হয়েছে,” বেনারকে বলেন লেদা ক্যাম্প ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।
“আমাদের ওপর চলমান নির্যাতনের ইতিহাস ও বিবরণ রয়েছে এই গানে। যে কারণে আমরা এখন বিশ্ববাসীর সামনে গানগুলো তুলে ধরতে চাই। তারানা গান আমাদের ওপর চালানো নির্যাতনের প্রতিবাদও বটে,” যোগ করেন আলম।
উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর ছয় বছর পার হয়েছে, একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়নি।
নিজেদের দুর্দশা ও দাবি-দাওয়া সহজবোধ্য করে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্যই প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁরা তারানা গান সংযোজন করেছেন।
“প্রচলিত সুরে সহজ কথায় তারানা গানের প্রতি রোহিঙ্গাদের বহু পুরানো মায়া জমে আছে,” জানিয়ে উখিয়ার রোহিঙ্গা সংগঠক নুর আহমেদ বেনারকে বলেন, “এটি এখন আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠছে।”
“তারানা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে,” বলেন আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) অন্যতম এই সংগঠক।
২০২২ সালের ১৯ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস সামনে রেখে মিয়ানমারে ফেরার দাবিতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় অনুষ্ঠিত ‘গো হোম ক্যাম্পেইনে’ প্রথমবারের মতো তারানা গানের ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছিল বেনার।
পরবর্তীতে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর, গত ২১ ফেব্রুয়ারি, ৮ জুন ও সর্বশেষ ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ব্যবহৃত একাধিক তারানা গান রেকর্ড করেছেন বেনার প্রতিনিধি।
আগে শরণার্থীরা প্রতিবাদের সময় শুধু ইংরেজিতে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন লিখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন জানিয়ে শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, এখন “রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের নিজস্বতা তৈরি হচ্ছে। এটা অবশ্যই একটা বড়ো পরিবর্তন।”
“গান, কবিতা, চিত্রকলা বা সিনেমার মতো শিল্পগুলো মানুষের মনের মধ্যে আবেগ তৈরি করে। সেই ভাবনা থেকেই হয়তো রোহিঙ্গারা এখন ভাবছে, বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ‘তারানা গীত’ নতুন মাধ্যম হতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা কালচারাল মেমোরি সেন্টারের (আরসিএমসি) ওয়েবসাইটের বিবরণ অনুযায়ী, ‘তারানা’ এক প্রকারের দুঃখের গান, যা মূলত বিলাপ প্রকাশের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক তারানাগুলোয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি, শরণার্থী জীবনের চাপ এবং হারানো বাড়িতে ফেরার আকাঙ্ক্ষার কথা রয়েছে।
“তারানা গীতে রোহিঙ্গাদের দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় জীবনের অনেক বিষয়ই ধারণ বা বর্ণনা করা হয়,” বেনারকে বলেন তরুণ গান সংগ্রাহক ও কবি মেয়্যু খান।
‘মুহিব উল্লাহর দেখা নাই’
“সব মানুষের দেখা আছে, শুধু মাস্টার মুহিব উল্লাহর দেখা নাই/ এমন করে মন পোড়ায়, মাস্টার মুহিব উল্লাহ ভাই।”
শুক্রবার শরণার্থী শিবিরে ২০২১ সালে দুর্বৃত্তের হাতে হত্যার শিকার রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে নিয়ে এই তারানা গানটি গাইছিলেন ৪২ বছর বয়সী শরণার্থী শিল্পী আহমাদ হোসেন।
২০১২ সালে বাংলাদেশে আসা এই গায়ক জানান, তিনি রোহিঙ্গা শিবিরে তারানা গান পরিবেশন করে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা উপার্জন করেন।
অন্যদিকে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের একটি কক্ষে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে তারানা গেয়ে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছিলেন আরেক পেশাদার গায়ক সিরাজুল ইসলাম: “কেউ স্বামী হারিয়ে ফেলেছে/ কেউ ছেলে-মেয়ে হারিয়ে ফেলেছে/ মগ-বর্মীরা জুলুম করেছে/ আমাদের রোহিঙ্গা মা-বোনদেরকে।”
৩৯ বছর বয়সী সিরাজুল বেনারকে জানান, তিনি ২৪ বছর ধরে গান গাইছেন। তাঁর গাওয়া এই গানটির গীতিকার কে তা তিনি জানেন না।
প্রচলিত সুরে এ ধরনের সুপরিচিত বিভিন্ন তারানা গান নিজের মতো করে গেয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন।
“রোহিঙ্গার কোনো শান্তি নাই/ এখন আছি দেশ-বিদেশে আটকে ও...ভাই,” তাঁর গাওয়া এই গানটি শরণার্থীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় বলে জানান সিরাজুল।
সংরক্ষণের উদ্যোগ
আরসিএমসির মতে, প্রায় ৫০ বছর আগে তারানাকে 'কবিতা গান' বলা হতো। এ গানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্ম, পরিচয় ও অস্তিত্ব জড়িত।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আরসিএমসি ঘিরে শরণার্থী তরুণদের মধ্যে বেশ গর্ব রয়েছে মনে করেন সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তা আসিফ মুনীর।
এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে অনেক রোহিঙ্গা গান সংগ্রহ করা হয়েছে জানিয়ে মেয়্যু খান বলেন, “আরসিএমসি চেষ্টা করেছে। অনেক টাকাও খরচ করছে।”
২৪ বছর বয়সী মেয়্যু স্বাধীনভাবে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভাষা নিয়ে একটি গবেষণা করছেন। তিনি নিয়মিত তাঁর সংগৃহীত গান সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেন।
“২০১৭ সাল থেকে আমি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গান সংগ্রহ করছি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য জানতে পারি না। সংগ্রহ করা গানের সংখ্যা শতাধিক হতে পারে,” বলেন মেয়্যু।
‘মিউজিক ইন এক্সাইল’ নামে একটি অলাভজনক অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড কোম্পানি বাংলাদেশের কিছু রোহিঙ্গা গান রেকর্ড করেছিল।
নিজেদের ওয়েবসাইটে রোহিঙ্গা গান প্রদর্শনের পাশাপাশি তারা বলেছে, রোহিঙ্গাদের সংগীত নিয়ে ইংরেজিতে খুব কম লেখা হয়েছে।
“শরণার্থী সংকট বিষয়ে গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান মনোযোগ সত্ত্বেও, তাঁদের ফেলে আসা অতীতের অনিবার্য অংশ- সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রায় কিছুই লেখা হয়নি, বরং অধিকাংশ প্রতিবেদনে শুধুই তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া নিপীড়নের বিবরণ রয়েছে,” জানায় ওই সংগঠনটি।
রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্যবাহী সংগীতগুলোর ভালো মানের রেকর্ডিংও খুব কম বলে জানায় তারা।