এক বছর পর রোহিঙ্গা শিবিরে আবার ইন্টারনেট চালু

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2020.08.28
ঢাকা ও কক্সবাজার
200828_BD-Rohingya-internet_1000.jpg কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে মোবইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন এক রোহিঙ্গা যুবক। ২৮ আগস্ট ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে আবারও দ্রুতগতির (থ্রিজি ও ফোরজি) ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গাদের অপরাধ ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ করা হলেও গত এক বছরে সেখানে মাদক চোরাচালানের মতো অপরাধ বন্ধ হয়নি।

এদিকে শুক্রবার থেকে শিবিরগুলোতে এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। ইন্টারনেট সুবিধা ফিরে পেয়ে দারুণ খুশি রোহিঙ্গারা। তাঁদের সাথে খুশি কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারাও।

রোহিঙ্গা শিবিরে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পুনরায় চালু করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (বিটিআরসি) চিঠি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “আশা করি সিদ্ধান্তটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।”

রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ প্রবণতা কমাতে এবং নিরাপত্তার কথা বলে গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির ও আশপাশের এলাকায় দ্রুত গতির থ্রি-জি ও ফোর-জি ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেয় সরকার।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে রোহঙ্গিাদের পাশাপাশি বিপাকে পড়েন স্থানীয় জনগণ।

করোনাকালে রোহিঙ্গা শিবিরে ইন্টারনেট সুবিধা চালুর আহ্বান জানিয়ে গত ২০ এপ্রিল দেশের ২৫ মানবাধিকারকর্মী বিবৃতি​ দেন।

এছাড়াও রোহিঙ্গা শিবিরে ইন্টারনেট চালুর জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিভিন্ন সময় আহ্বান জানানো হয়।

“বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট চালুর ব্যাপারে আমাদের কাছে অনুরোধ আসে। মূলত সেই কারণেই খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত,” রোহিঙ্গা শিবিরে আবার ইন্টারনেট চালুর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেনারকে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বাংলাদেশ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার পর রোহিঙ্গারা সীমান্তের ওপারে বসানো টাওয়ার ব্যবহার করে মিয়ানমারের মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করেছিল জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের অপরাধ ঠেকাতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হলেও দেখা গেলো, তাঁদের অপরাধ প্রবণতা বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ হয়নি।”

“রোহিঙ্গাদের অনেকেই মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছিল। কেউ কেউ কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই চোরাচালান চালাচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ করার ফলে মূলত বিপত্তিতে পড়েছে স্থানীয় জনগণ,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

পুলিশের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গোলাগুলির ঘটনায় কক্সবাজারে মোট ৭৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ জন রোহিঙ্গা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ক্রসফায়ারে ৩৬১ জন নিহত হন, এদের মধ্যে ৪০ জন রোহিঙ্গা।

শরণার্থী শিবিরে পুনরায় ইন্টারনেট চালুর বিষয়ে শুক্রবার পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন পাননি জানিয়ে কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসু দ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “তবে রোহিঙ্গা শিবির থেকে ক্যাম্প ইনচার্জসহ অনেকেই এই সেবা পুনরায় চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।”

এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে পুনরায় ইন্টারনেট চালু করলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি সিম কার্ড ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে কিছু জানাননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এর আগে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ার কারণে তাঁরা বাংলাদেশি সিম কিনতে পারবেন না।

‘বিশ্বের খবরাখবর থেকে বঞ্চিত ছিলাম’

ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার কারণে গত এক বছর রোহিঙ্গাদের জীবন শুধুমাত্র শরণার্থী শিবিরের ভেতরে গণ্ডিবদ্ধ ছিল জানিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান মো. রশিদ বেনারকে বলেন, “আমরা বিশ্বের সব ধরনের খবরাখবর থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিলাম। আমার মনে হচ্ছে এখন রোহিঙ্গারা নতুন জীবন পেয়েছে।”

তিনি বলেন, “অনেক শরণার্থীর আত্মীয়–স্বজন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ–আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় স্বজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা যেত না। এখন আমাদের সেই সমস্যা দূর হবে।”

“এখন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের জন্য কে কী করছে এবং মিয়ানমারের সব খবরাখবর নিয়মিত জানা যাবে,” বলেন রশিদ।

“এটি রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই খুশির খবর,” মন্তব্য করে রোহিঙ্গা নেতা সিরাজুল মোস্তফা বেনারকে বলেন, “এই সেবার (ইন্টারনেট) কারণে অনেক রোহিঙ্গা মানসিক চাপমুক্ত হবে। শিশুরা বিনোদনের প্ল্যাটফর্ম পাবে, শিক্ষার সুযোগও বাড়বে।”

তিনি বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে করোনা মহামারি চলছে। ক্যাম্পগুলোতে এ সংক্রান্ত কোনো ধরনের আপডেট খবর আমরা পেতাম না। এখন সেই দুঃশ্চিন্তা দূর হবে। লোকজনের মাঝে সচেতনতাও বৃদ্ধি পাবে।”

এদিকে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করার কারণে এতদিন স্থানীয় মানুষেরা ‘চরম ভোগান্তিতে’ ছিলেন বলে বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উখিয়া উপজেলার সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিকদার।

“নেটওর্য়াক বন্ধ থাকলেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নেটওর্য়াক ব্যবহার করেছে, তাঁদের অনেকের সমস্যা হয়নি। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের যে দুর্ভোগ ছিল তা এখন লাঘব হবে।”

তবে ইন্টারনেট চালুর ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অপরাধ কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবার আশঙ্কা করে নূর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, “মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে অপরাধ আরও সহজ হতে পারে। তাই এ বিষয়টি সরকারের গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত।”

রোহিঙ্গা মানেই অপরাধী নয়

ঢালাওভাবে রোহিঙ্গাদের অপরাধী ভাবা উচিত নয় বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

“রোহিঙ্গা হলেই অপরাধ করবে আর স্থানীয় হলেই অপরাধ করবে না এমন কথা নেই,” মন্তব্য করে ড. হেলাল বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবাই কি অপরাধী? সেখানে কি ভালো মানুষ নেই?”

“সুতরাং, কোনো একটি বিশেষ গোত্রের মানুষকে ঢালাওভাবে অপরাধী বলা ঠিক নয়” বলেন ড. হেলাল।

তাঁর মতে, ইন্টারনেট বন্ধ করে অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত সঠিক উপায় বের করে উখিয়া-টেকনাফের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা।

“আমি মনে করি, ইন্টারনেট বন্ধ করে অপরাধ খুব একটা কমেনি। আর মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোনও সমাধান নয়” বলেন তিনি।

সরকারি হিসাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার জেরে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। আগে থেকে বসবাসকারী রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছেন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

করোনায় আক্রান্ত ১০১ রোহিঙ্গা

এদিকে শুক্রবার পর্যন্ত ১০১ জন রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বকারী ডা. আবু তোহা।

তিনি জানান, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ছয় জন রোহিঙ্গা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ছয় হাজার ৭৯৪ জন। আর মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ১৭৪ জনের।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট দুই কোটি ৪৫ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন আট লাখ ৩৩ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।