ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রলুব্ধ করছে পাচারকারীরা

আরএফএ বার্মিজ
2023.08.29
ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রলুব্ধ করছে পাচারকারীরা কক্সবাজারের চাকমারকুল এলাকায় একটি নৌকায় বেল্ট এবং দড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মারধর করছে একজন বার্মিজ চোরাকারবারি। ২৬ আগস্ট ২০২০।
[এএফপি/হ্যান্ডআউট]

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা গ্রামের শোচনীয় অবস্থা, কাজের সুযোগের অভাব এবং চরম বৈষম্যের শিকার হলেও যেকোনোভাবে টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন ৪৫ বছর বয়সী বোচোল্লা। তাই তাঁর ১৮ বছর বয়সী ছেলেকে থাইল্যান্ডে পাঠাতে তিনি পরিবারের প্রায় সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছেন।

আশা ছিল ছেলে ব্যাংককে একটি নতুন সুখী জীবন শুরু করতে পারবে; কারণ নিজ দেশে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে আছেন।

“এক দালাল তাকে ইয়াঙ্গুন হয়ে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে নিয়ে গিয়েছিল এবং বলেছিল যে তার সাথে খারাপ কিছু ঘটবে না,” রথিডং জনপদের নিয়াং পিন গেই গ্রামে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার বার্মিজ সার্ভিসকে বলেন বোচোল্লা।

পাচারকারীদের দাবি অনুযায়ী ছেলেকে পাঠানোর খরচ বাবদ ৬.৫ মিলিয়ন কিয়াট (৩,১০০ ইউএস ডলার) সংগ্রহ করার জন্য বোচোল্লা তাঁর জমি আর বাড়ি বিক্রি পাশাপাশি উচ্চ সুদে ঋণও নিয়েছিলেন।

জানুয়ারিতে ছেলে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বোচোল্লা জানতে পারেন তাকে ম্যাগওয়ে অঞ্চলের মিনবু এলাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তখন থেকে ছেলের সাথে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

“যে দালালের মাধ্যমে গেছে আমি তাঁকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি তার কী হয়েছে এবং পরবর্তীতে কী করতে হবে? কিন্তু তিনি কখনই জবাব দেননি,” তিনি বলেন।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক দমন অভিযানে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নির্মিত অস্থায়ী গ্রাম এবং ক্যাম্পে বসবাসকারী কয়েক হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে বোচোল্লা ও তাঁর পরিবার একটি।

রাখাইনের সিত্তে শহরের যে শিবিরে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন যেটিকে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থা “উন্মুক্ত কারাগার” হিসেবে অভিহিত করেছে।

rohingya 2.jpg
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের ক্রুয়েঙ গেউকুয়েহ বন্দরে নামার জন্য কাঠের নৌকায় অপেক্ষ করছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ৩১ ডিসেম্বর ২০২১। [গেটি ইমেজের মাধ্যমে ফখরুল রেজা/সিনহুয়া]

যেতে মরিয়া

২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর নির্মূল অভিযানের সময় রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। স্বদেশে প্রত্যাবাসনের নামে রাখাইন রাজ্যের সেই ক্যাম্পে পাঠানোর কর্মসূচিতে যোগ দিতে তাঁরা রাজি নন। তাঁরা তাঁদের মূল বাসস্থানে ফিরতে চান। তাঁরা ক্যাম্পগুলোকে নিরাপদ মনে করেন না।

কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় থাকার পর বিকল্পের সন্ধানে অনেক রোহিঙ্গা এখন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের মতো দেশগুলোতে জল অথবা স্থলপথে চলে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য করছেন। এই প্রাণান্তকর চেষ্টার কারণে তাঁরা মানবপাচারকারীদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন।

বোচোল্লার এই করুণ অভিজ্ঞতা রাখাইন ও বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের জন্য বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বাস্তুচ্যুতদের গ্রাম এবং বিভিন্ন ক্যাম্পজুড়ে একই ধরনের গল্প অনেক।

একজন পাচারকারী রাখাইনের রথিডং শহরাঞ্চলে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ১৬ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ছেলে মামতোসোলিন সম্প্রতি সিত্তের ওহন তাও ঘি (উত্তর) রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়।

তার বাবা জানিয়েছেন, চাকরির পরিবর্তে তার ছেলেকে আটকে রেখে ৬ মিলিয়ন-কিয়াট (২,৮৬০ ডলার) মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে।

“আমাদের কাছে এত টাকা নেই, তাই আমরা ৩ মিলিয়ন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু তারা আমাদের ছেলেকে ফেরত দেবে না,” তিনি বলেন। “এখন তারা বলছে আমরা তাদের দাবি মিটাতে না পারলে তাকে মেরে ফেলা হবে।”

মামোতসোলিনের বাবা বলেছেন, তিনি অপহরণ এবং মানবপাচারের বিষয়ে সিত্তের শহরের একটি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ রয়েছে।

পাচারকারী চক্র

রোহিঙ্গারা আরএফএকে বলেছেন, প্রতিটি গ্রামে এবং আশ্রয় শিবিরে “কমপক্ষে তিনজন মানবপাচারকারী” রয়েছে এবং তাদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর সদস্য।

তাঁরা বলেছেন, এই দালালরা লোকজনকে বুঝিয়ে প্রলুব্ধ করার কাজ করে। এরপর তারা শিকারকে তাদের দ্বিতীয় স্তরের পাচারকারী চক্রের সাথে যুক্ত করে দেয়, যারা ইয়াঙ্গুনের মতো শহরে তাদের পরিবহনের ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে তৃতীয় স্তরের পাচারকারী চক্র শিকারদের তৃতীয় স্থানে পাঠায় এবং যেখানে তাদের শ্রমের জন্য বিক্রি করা হয় বা মুক্তিপণের জন্য আটকে রাখা হয়।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করা দাতাগোষ্ঠীর সদস্যরা আরএফএকে বলেছেন, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের পাচারকারীদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি জাতিগত রাখাইন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা রয়েছে। তারা বলেছেন, পাচারকারীরা বাংলাদেশের শিবির থেকেও রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে নিয়ে আসে এবং অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার আগে তাদের “দলবদ্ধ করে” রাখে।

এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য আরএফএ বিভিন্ন স্তরের অন্তত ১০ জনের সাথে কথা বলেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা মানবপাচার সচেতনতা কর্মী, সহায়তা কর্মী যারা অপরাধী গ্রেপ্তারে সহায়তা করে, রোহিঙ্গাদের আইনজীবী, বাস্তুচ্যুতদের ক্যাম্প ও গ্রামের রোহিঙ্গা, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা এবং রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী।

একজন মানবপাচার সচেতনতা কর্মী বলেছেন, বেশিরভাগ পাচার চক্র রথিডং শহরের আহ নাউকপিন এবং নিয়াং পিং গি গ্রামে সক্রিয়।

“তাদের গ্রুপের প্রধানরা ইয়াঙ্গুন এবং থাইল্যান্ডে থাকে, যারা নিম্নস্তরের পাচারকারীদের প্রণোদনা দেয়। যেমন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিকার সংগ্রহ করতে পারলে জনপ্রতি ২০০,০০ কিয়াট (৯৫ মার্কিন ডলার) দেয়,” নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আরএফএকে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ শিবিরের লোকজন, সেইসাথে রাখাইনের বুথিডং, মংডু এবং সিত্তে শহরের লোকেরাও সেখানে চলে যায়। ওই গ্রামগুলো তাদের জন্য মিলনস্থল।”

একজন রোহিঙ্গা সাধারণত রাখাইন রাজ্য থেকে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য পাচারকারীদের ৬ মিলিয়ন থেকে ১২ মিলিয়ন কিয়াট (২,৮৬০ ডলার থেকে ৫,৭২০ ডলার) দিয়ে থাকেন, যেখানে বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে আসারা প্রায় ৩০০,০০০ টাকা (২,৭৫০ ডলার) দেন।

rohingya 3.jpg
রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তের থাইচাং শিবিরে কয়েকজন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা। ২১ এপ্রিল ২০২৩। [আরএফএ]

বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন

বাংলাদেশে থানখালি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুব সমিতির পরিচালক খিনমাউং বলেছেন শিকার সংগ্রহকারীরা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জীবিকা অর্জনের জন্য অন্য দেশে চলে যেতে বোঝানোর কাজ করে।

“তারা [ভুক্তভোগীদের] এই বলে প্ররোচিত করে ক্যাম্পে ভালো খাবার ব্যবস্থা নেই এবং তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতেও পারবে না। তাই তাদের সারাজীবন এভাবেই থাকতে হবে অথবা তারা চাইলে বিদেশে গিয়ে উন্নত জীবন গড়তে পারবে। নিরীহ লোকেরা এই টোপ গিলে শিকারে পরিণত হয়,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের আইনি সহায়তা প্রদানকারী একজন আইনজীবীর মতে, যারা চলে যাওয়ার চেষ্টা করে শুধু তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তাদের পাচারকারীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়।

তিনি বলেন, পাচার চক্রগুলো সাধারণত তাদের অপারেশনের চেইন সংযোগ সবসময় বিচ্ছিন্ন রাখে যাতে পাচারকারীদের ধরা না যায়।

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার করা হলে শুধু ভিকটিম রোহিঙ্গাদের এবং ডক শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করা হয়; পাচারকারী বা নৌকার মালিকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়”।

রোহিঙ্গা সমাজকর্মী এবং বাসিন্দারা বলছেন, জান্তা এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মানব পাচার হয়। তবে এই গ্রুপগুলো পাচার চক্রের সাথে জড়িত কিনা তা বলতে তারা রাজি হননি। কারণ এতে প্রতিশোধের টার্গেটে পরিণত হওয়ার ভয় আছে।

মন্তব্যের জন্য আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইংথুখা এবং জান্তার উপ-তথ্যমন্ত্রী মেজর জেনারেল জাও মিন টিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা উত্তর দেননি।

যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের ট্রাফিকিং ইন পারসন্স রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে মানব পাচার নির্মূল করার জন্য মিয়ানমার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা নেয়নি এবং সমস্যা মোকাবেলায় সহযোগিতা করার ইচ্ছার দিক থেকে তারা বিশ্বের তৃতীয় নিকৃষ্টতম দেশ।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে অন্তত ২,৪০০ রোহিঙ্গা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবির থেকে সমুদ্র যাত্রা করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি।

ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নে সান লুইন আরএফএকে বলেছেন, শুধুমাত্র ২০২২ সালেই ৪০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা অন্য দেশে যাওয়ার পথে মারা গেছে।

রোহিঙ্গা অধিকার কর্মীরা মানবপাচার রোধে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় শিবিরে এবং গ্রামে পুলিশি নজরদারি আরও উন্নত করা এবং রোহিঙ্গাদের ভ্রমণ, কাজ এবং শিক্ষা গ্রহণের অধিকারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।