অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ৩ রোহিঙ্গা নারীর মৃত্যু

আবদুর রহমান ও আহম্মদ ফয়েজ
2022.10.04
কক্সবাজার ও ঢাকা
অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ৩ রোহিঙ্গা নারীর মৃত্যু অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টাকালে বঙ্গোপসাগরে নৌকাডুবির পর উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার টেকনাফের তীরে বসিয়ে রেখেছেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। ৪ অক্টোবর ২০২২।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলীয় বঙ্গোপসাগরে একটি ট্রলার ডুবিতে তিন রোহিঙ্গা নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাত এগারোটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় ২৫ জন নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ও পুলিশের কর্মকর্তারা।

তাঁরা জানিয়েছেন, নৌকাডুবির ঘটনায় ঘটনায় আরো ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে চার বাংলাদেশি দালালও রয়েছেন।

“আমাদের লোকবল সংকট থাকায় ও ঘটনাটি গভীর সাগরে হওয়ায় উদ্ধার অভিযান চালানো সহজ হচ্ছে না। কোস্টগার্ডের টহল টীম ও স্থানীয় জেলেদের ঘটনাস্থলে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে লাশ ভেসে ওঠে কিনা তা দেখতে,” বেনারকে বলেন কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. আশিক আহমেদ।

টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক নুর মোহাম্মদ জানান, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া মেরিনড্রাইভ শীলখালী সমুদ্র সৈকত থেকে তিন রোহিঙ্গা নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

“সোমবার গভীর রাতে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাবাহী ট্রলারটি রওনা দেয়। কিছুদূর যাবার পর বৈরী আবহাওয়া ও অতিরিক্ত মানুষ বোঝাইয়ের কারণে ট্রলারের তক্তা ফেটে যায়, এরপর সেটি সাগরে ডুবে যায়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের সহায়তায় কোস্ট গার্ড চার বাংলাদেশি দালালসহ ৪৫ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ধারণা করা হচ্ছে ট্রলারে অন্তত ৭০ জন যাত্রী ছিলেন,” যোগ করেন নুর মোহাম্মদ।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানান, উন্নত জীবনের আশায় কক্সবাজারের শিবির থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন তাঁরা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা কিশোরীরা বিয়ের উদ্দেশে মালয়েশিয়া যাত্রা করছিলেন বলে জানান তাঁরা।

এ ঘটনায় আটকৃতরা চার পাচারকারী হলেন; কক্সবাজারের মহেশখালী কুতুবজুম গ্রামের বাসিন্দা করিম উল্লাহ ছেলে মো. সেলিম (২৪), একই এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে কোরবান আলী, ঈদগাঁওর হাজীপাড়ার রশিদ আহমদের ছেলে মো. আবদুল্লাহ (২০) এবং টেকনাফের কাটাবনিয়া এলাকার হাসান আলীর ছেলে শহীদ উল্লাহ (২৮)।

কোস্টগার্ড কর্মকর্তা আশিক আহমেদ বলেন, “মঙ্গলবার ভোরে মুঠোফোনে আবু আনছার (১৫) পরিচয়ে এক রোহিঙ্গা যুবক কান্নাকাটি করে ৯৯৯-এর ফোন করে সহযোগিতা চায়। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর লোকেশন শনাক্ত করে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে জেলেদের সহায়তায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করি।”

সেন্টমার্টিনে বড়ো নৌকায় উঠার কথা ছিল রোহিঙ্গাদের

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন এবং তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন।

উদ্ধার হবার পরে টেকনাফ শালবনের বাসিন্দা রোকসানা বেগম বলেন, “আমার স্বামী দীর্ঘ দিন মালয়েশিয়া রয়েছে। তার কাছে যাওয়ার জন্য সাগরপথে পাড়ি দিচ্ছিলাম। এর আগেও যাত্রা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। ট্রলারে আরও অনেক শিশু ও নারী ছিল। ট্রলার ডুবির সময় তাদের সাগরে ডুবে যেতে দেখেছি।”

তিনি জানান, মূলত রোহিঙ্গা শিবিরে বিয়ে করতে চাইলে বর পক্ষকে বড়ো অংকের যৌতুক দিতে হয়। তাই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় থাকা রোহিঙ্গা ছেলের সাথে মোবাইলে বিয়ে দিয়েছে পরিবার। তাঁর কথামতো সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন তিনি।

উদ্ধার হওয়া আরেক যাত্রী রোহিঙ্গা রোকেয়া জানান, মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনিসহ তাঁর ক্যাম্পের পাঁচজন ওই ট্রলারে উঠেছিলেন। কিন্তু ট্রলার ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই সেটি ডুবে যায়।

“কোস্টগার্ডের হাতে আমিসহ তিনজন উদ্ধার হলেও বাকিদের খোঁজ নেই,” বলেন রোকেয়া।

২০১৭ সালে আগস্টে মিয়ানমার থেকে এসে টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী এই নারী আরও জানান, ওই ট্রলারে থাকা বেশিরভাগ যাত্রীই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।

বাংলাদেশি যুবক কোরবানি আলী বলেন, “আমরা কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাসহ ৮ জন ট্রলারে উঠি। পরে সোমবার রাতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট নৌকা করে আরো মালয়েশিয়াগামী এই ট্রলারে উঠে। এভাবে টেকনাফ-কক্সবাজার থেকে প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলার যাত্রা করে। মূলত তাদের সেন্টমার্টিনের উত্তরে বঙ্গোপসাগরে একটি বড়ো জাহাজে (বড় নৌকা) উঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগে ট্রলারটি ডুবে যায়।”

ট্রলারডুবি থেকে উদ্ধার হওয়া আরেক রোহিঙ্গা নুর আহমদ জানান, তিনি দালালকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং বাকি টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর পরিশোধ করার কথা ছিল।

“মূলত পরিবারের কথা চিন্তা করে, উন্নত জীবনের আশায় সাগর পথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছি,” বলেন নুর আহমদ।

“ট্রলারে প্রকৃতপক্ষে কতজন যাত্রী ছিল তা বলা খুব মুশকিল,” মন্তব্য করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার হওয়া জীবিত রোহিঙ্গাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষে নিজ ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে। এবং “আটক দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।”

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছালেও দেশটিতে প্রবেশ করতে না পেরে টেকনাফের বাহারছড়া সমুদ্র সৈকত থেকে ফিরে আসা ৩৯৬ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছিল বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। ওই দলের সঙ্গে থাকা অন্তত ৩০ রোহিঙ্গা খাবার ও পানি সংকটে মারা যান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

Shayon
2022-10-05 02:10

Rohingyas are human being too. They also hope for a better life. And they can get their right to better life only from their state. The government of Bangladesh is constantly working for them. But their state also needs to take action for them.