সহজলভ্য মাদক বহনকারী হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে রোহিঙ্গারা

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2018.10.11
কক্সবাজার
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
181011_CoxDrug_1000.jpg কক্সবাজারের কুতুপালং-বালুখালী মেগাক্যাম্পে বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা নারী। ৩১ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

সহজলভ্য ও সস্তা ‘মাদক বহনকারী’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে বসবাসকারী শরণার্থী রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আমদানির কাজে যুক্ত হচ্ছে পুরুষেরা আর নারীরা ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের ভেতরে তা পরিবহনের কাজে।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফয়েজু আরাকানির (৪৮) ভাষায় ‘অভাবের তাড়নায়’ রোহিঙ্গারা মাদক পাচারে জড়িত হলেও টেকনাফের লেদা শিবিরের ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেবের (৬৮) মতে, “অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের এ কাজে জড়াচ্ছে।”

রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে একমত করে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, “কিছু স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী রোহিঙ্গাদের এ কাজে জড়াতে সহায়তা করছে, এমন তথ্য আমরাও পেয়েছি। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর অভাবের সুযোগ নিচ্ছে তারা।”

তবে অনেক প্রভাবশালী রোহিঙ্গাও মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা।

এদিকে “বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে মানব পাচার, মাদকদ্রব্য চোরাচালানসহ সংঘবদ্ধ অন্যান্য অপরাধের ঝুঁকি বেড়েছে,” বলে গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এমন প্রেক্ষিতে ‘ইয়াবা’ পরিবহন, কেনাবেচা, সংরক্ষণ ও উৎপাদন ইত্যাদি অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যেগ নিয়েছে সরকার। গত সোমবার সংশোধনীর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

মাদক সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও একই ধরনের শাস্তি পেতে হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।

প্রসঙ্গত, দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে কঠোর সাজা রেখে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত মে মাস থেকে চলমান মাদকবিরোধী যুদ্ধে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এর অধিকাংশই নিহত হয়েছেন পুলিশ ও র‌্যাবের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’।

জনবহুল শিবিরে গড়ে উঠেছে আখড়া

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত এক বছরে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে পাঁচ শতাধিক মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া গড়ে উঠেছে। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে জনবহুল এই ক্যাম্পগুলো।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা কারবারির তালিকায়ও রয়েছে ১৩ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গার নাম। তবে এই তালিকায় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি।

রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, ইয়াবা গডফাদারদের অধিকাংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ট বা স্বজন।

এদিকে “মাদক ব্যবসায় রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে পুলিশের জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে,” বলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন দাবি করলেও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, প্রয়োজনীয় ফোর্সের অভাবে শিবিরের মাদক আখড়াগুলো উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। প্রায় ১১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য নিয়োজিত পুলিশের সংখ্যা এক হাজারেরও কম।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট অবধি রোহিঙ্গা শিবিরগুলো থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ইয়াবাসহ ১১১ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মাদক-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৮২টি।

র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব-৭) কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর মেহেদী হাসান বেনারকে বলেন, “দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান শুরুর পর স্থানীয় অনেক ইয়াবা পাচারকারীও রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।”

“যে কারণে শিবিরগুলোয় আমাদের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

অন্যদিকে “রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় মাদকের বিস্তার নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন,” মন্তব্য করে “সীমান্তের পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোয় নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোঃ আছাদুদ-জামান চৌধুরী।

নারীদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে

টেকনাফ মডেল থানার ওসি রণজিৎ কুমার বড়ুয়া বেনারকে জানান, গত এক বছরে তাঁর এলাকায় কমপক্ষে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গাকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার মধ্যে ১০ জনের বেশি নারী।

তিনি বলেন, “ইয়াবা পাচারে রোহিঙ্গা নারীদের ব্যবহারের প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে।”

মেজর মেহেদী বেনারকে বলেন, “পুরুষদের তুলনায় নারীরা সাধারণত কম তল্লাশির শিকার হন। পাচারকারীরা এই সুযোগটাই নিয়ে থাকে।”

“ইয়াবা ব্যবসায় বেশি জড়াচ্ছে ক্যাম্পের স্বামীহারা নারীরা। আসলে তারাই এখানে সবচেয়ে অসহায়,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা নেতা ফয়জু।

রোহিঙ্গা নেতারা জানান, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনার কাজে নতুন রোহিঙ্গারাই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

তারা বলেন, লেদা ক্যাম্প থেকে মংডু শহরে পৌঁছাতে পাচারকারীদের বড়জোর চার ঘন্টা লাগে। তারা সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে ওপারে যাওয়া-আসার নিরাপদ পথ চেনে।

“সাধারণত তারা বিকেলের দিকে এপার থেকে রওনা করে পরের দিন রাতে ফিরে আসে,” বলেন লেদার এক রোহিঙ্গা নেতা।

সহিংসতার নেপথ্যেও ইয়াবা

গত ৩১ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে লেদার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা প্রহরী মো. আবু ইয়াছেরকে (২২) বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত।

“ইয়াবা-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে,” মন্তব্য করে টেকনাফের ওসি জানান, “এই শিবিরে ইয়াবা বিক্রির কয়েকটি সিন্ডিকেট আছে।”

বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যত সহিসংতা ঘটছে তার সিংহভাগের জন্য ‘ইয়াবা’ ব্যবসা দায়ী বেলে জানান রোহিঙ্গা নেতা মোতালেব।

তিনি বলেন “ইয়াছের হত্যার পর লেদা ক্যাম্পের ছয় ব্লকের আড়াইশ সেচ্ছাসেবী প্রহরী এখন দায়িত্ব পালন করতে ভয় পাচ্ছে।”

“যারা ‘গডফাদার’, তাদের আমরা ধরতে পারি না। তবে যারা ‘ক্যারিয়ার’ তাদের ধরে আমরা পুলিশে সোপর্দ করেছি,” বেনারকে জানান বিভিন্ন শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।