খাবারের কষ্টের কথা মার্কিন প্রতিনিধিকে জানালেন রোহিঙ্গারা
2023.10.17
ঢাকা ও কক্সবাজার
“আমি অন্তঃসত্ত্বা। এ সময় বেশি বেশি খাওয়া উচিত। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করতে পারছি না। কারণ, আমাদের খাদ্য সহায়তা কমে গেছে। গর্ভের বাচ্চা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।”
কথাগুলো কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী শিবিরের ২৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী জামিলা আক্তারের।
মঙ্গলবার বাংলাদেশে সফররত মার্কিন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গেলে এভাবেই নিজের অবস্থা তুলে ধরেন জামিলা। পরে বেনারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা জানান।
শুধু জামিলা নয়, তাঁর মতো অনেক শরণার্থী নিজেদের খাদ্য সংকটের কথা জানান আফরিনকে।
দুই দিনের সফরের শেষ দিন মঙ্গলবার আফরিন আখতারের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় কয়েকটি শরণার্থী শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে বলে বেনারকে জানান সফরকালে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কক্সবাজারের ১৪ এপিবিএনের সহ-অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মোঃ সাইফুজ্জামান।
এছাড়াও তাঁরা ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি ও আইওএমসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) দুই দফায় বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় খাবার।
অর্থ সংকটের কারণে চলতি বছরে মে মাসে ডব্লিউএফপি প্রথমে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিমাসে মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করে। পরে জুনে তা আরো কমিয়ে করা হয় আট ডলার।
রেশনে সংসার চলে না
উখিয়া বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা নুর আজিম বেনারকে জানান, শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে মার্কিন প্রতিনিধিরা তাঁদের কাছে শিবিরের পরিস্থিতি জানতে চান।
তিনি বলেন, “ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কার্যক্রম আগের তুলনায় উন্নতি হলেও রেশন কমিয়ে দেওয়ায় আমরা যে কষ্টে আছি সেটি তুলে ধরি। তিনি বিষয়গুলো দেখবেন বলে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেন।”
নুর জাহান নামে আরেক রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, “আমি মার্কিন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি যে, আমার ঘরে সাত সদস্য রয়েছে। রেশন হিসেবে যা পাই তা দিয়ে চলে না। …অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের অবস্থাই খুব খারাপ। এতে রোহিঙ্গারা হতাশ হয়ে পড়েছে।”
“অভাবের কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে কাজের সন্ধানে বের হওয়া প্রবণতা বাড়ছে। এতে ধরাও পড়ছে পুলিশের হাতে। আবার অনেকে অভাবের কারণে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন তিনি।
বর্তমানে যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে “সংসার চলে না,” জানিয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম (৪২) বেনারকে বলেন, এর ফলে তাঁর স্বামী ও ছেলেরা “ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়।”
শরণার্থী শিবিরের বাইরে গিয়ে তাঁর স্বামী ও ছেলেরা “মাসে ১০-১৫ দিন” কাজ করে বলে জানান আনোয়ারা। তিনি বলেন, “যারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না, তাদের সংসার চলছে কষ্টে।”
আগের তুলনায় বর্তমানে কম রেশন পাওয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা মাস্টার জোবাইর।
তিনি বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে রোহিঙ্গারা অপরাধে ঝুঁকবে। পাশাপাশি ক্যাম্পে অস্থিরতা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি: আফরিন
এদিকে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে আফরিন বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি।
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এবং একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই ও স্থায়ী সমাধানও চায়,” বলেন তিনি।
মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি দাবি করে আফরিন বলেন, “মিয়ানমার সরকার সেখানে কোনো মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে দিচ্ছে না এবং রোহিঙ্গাদেরকে তাদের গ্রামে ও বাড়িতে বসবাস করতে দিচ্ছে না।”
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ জানান তিনি।
রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাজ্যের ৬০ কোটি টাকা
বাংলাদেশের বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তায় আরো ৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা সাড়ে চার মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক ব্রিটিশ মন্ত্রী অ্যান-মারি ট্রিভেলিয়ান থাইল্যান্ডে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) আঞ্চলিক সম্মেলনে এ সহায়তার ঘোষণা দেন।
মঙ্গলবার ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডির সঙ্গে মিনিস্টার ট্রেভেলিয়ান সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।
ইন্দো-প্যাসিফিক মন্ত্রী ট্রেভেলিয়ান বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজতে যুক্তরাজ্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মধ্যে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন অন্তর্ভুক্ত, যখন সেখানকার পরিস্থিতি অনুকূল হয়।”
২০০৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয়দের জন্য যুক্তরাজ্য ৩৭০ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা করেছে বলে জানায় দেশটির দূতাবাস।
এদিকে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য চলতি বছর প্রায় ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৪২ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ মিলছে বলে জানান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।
বার্তাসংস্থা এএফপি জানায়, গ্রান্ডি বলেন বলেন, “এই সংকট কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না। … যদি বরাদ্দ কমে আসে, তবে কঠিন সমস্যায় পড়ব আমরা।”