শরণার্থী শিবির: পরপর খুনের ঘটনায় রোহিঙ্গারা আতঙ্কে

সুনীল বড়ুয়া ও কামরান রেজা চৌধুরী
2021.10.26
কক্সবাজার ও ঢাকা
শরণার্থী শিবির: পরপর খুনের ঘটনায় রোহিঙ্গারা আতঙ্কে কক্সবাজার উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে হামলার শিকার 'দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ' মাদ্রাসার সামনে পুলিশ পাহারা, দরজায় দাঁড়ানো এক ছাত্র। ২৬ অক্টোবর ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে খুনের এক মাসের কম সময়ের মধ্যে একটি মাদ্রাসায় ছয়জনকে একসাথে হত্যার পর চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন শরণার্থী শিবিরের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এদের অনেকেই রাতে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

শিবিরের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও অস্থিরতার জন্য জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করছেন নিহতের স্বজনেরা। যদিও সরকারের মতে, বাংলাদেশের আরসার অস্তিত্ব নেই।

তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শরণার্থী শিবিরে আরসার উপস্থিতি আছে এবং তাদের কঠোরভাবে দমন না করলে তারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

উখিয়া বালুখালীর ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ নামের যে মাদ্রাসায় গত ২২ অক্টোবর হামলা করে ছয় শরণার্থীকে হত্যা করা হয়েছে, সেটির অধ্যক্ষ মৌলভী দিল মোহাম্মদ মঙ্গলবার বেনারকে জানান, এই মাদ্রাসাটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল আরসা।

“এ ছাড়া এই মাদ্রাসাটির অবস্থানগত কারণে বিভিন্ন সময় সরকারের লোকজন (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) ব্যবহার করে। যে কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা এখানেই হামলা চালিয়েছে,” বলেন দিল মোহাম্মদ।

নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে গত সোমবার থেকে তিনি ওই মাদ্রাসায় থাকেন না জানিয়ে দিল মোহাম্মদ টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “বর্তমানে আমি নিরাপদ স্থানে আছি। ঘটনার পর থেকে ওই এলাকার রোহিঙ্গারা খুব আতঙ্কে আছে।”

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মতে, “আরসা নামক কোনো সংগঠন বাংলাদেশে নেই।”

মঙ্গলবার গণমাধ্যমের কাছে তিনি এই মন্তব্য করেন বলে বেনারকে জানান মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।

“মুহিব উল্লাহ প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছিলেন। তবে অনেক গ্রুপ আছে যারা চায় না প্রত্যাবাসন হোক,” জানিয়ে মন্ত্রী বলেন প্রত্যাবাসনবিরোধী সেইসব দল “এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে,” বলেন মন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আবার যে দেশ (মিয়ানমার) তাদেরকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে তাদেরও ইন্ধন থাকতে পারে। আবার ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে; তারাও ঘটাতে পারে।”

মুহিব উল্লাহ ও মাদ্রাসায় হত্যাকাণ্ড সরকার তদন্ত করছে বলেও জানান তিনি।

রাতে খুব ভয় লাগে

গত ২২ অক্টোবর ভোর রাতে উখিয়া বালুখালী শরণার্থী শিবিরের ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মঙ্গলবার দুপুরে ওই মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন বেনারনিউজ প্রতিনিধি।

পুরো মাদ্রাসাটি ছিল ফাঁকা। তবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মাদ্রাসাটি পাহারায় ছিলেন। মাদ্রাসা জুড়ে পাওয়া গেলো নয় বছর বয়সী মাদ্রাসা ছাত্র মো. ছালেহকে।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ছালেহ বেনারকে জানায়, “সেদিন ভোর বেলায় হঠাৎ করে আক্রমণ হয়। আক্রমণকারীরা যাকে সামনে পেয়েছে তাকে জবাই করেছে, গুলি করেছে।”

আক্রমণের সময় মাদ্রাসায় থাকা তার বড় ভাই সুলতান আহম্মদ (১৬) গুরুতর আহত হয়। ঘটনার পর থেকে খুব ভয়ের মধ্যে দিন কাটছে বলে জানান ছালেহ।

ওই ঘটনার পর আতঙ্ক কাটছে না রোহিঙ্গাদের। হামলার বিষয় নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চান না কেউ।

নিজ ঘরের সামনে দেখা হয় সেদিনের ঘটনায় নিহত মো. আমিনের শাশুড়ি হামিদা খাতুনের (৫৫ বছর) সঙ্গে।

“আমরা খুব দুঃখে আছি। দিনের বেলায় যেমন তেমন, রাতে খুব ভয় লাগে। তারা (আরসা) হুমকি দিচ্ছে ব্লকে আগুন ধরিয়ে দিবে। ঘর থেকে বের হতেও ভয় লাগে,” বেনারকে বলেন হামিদা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শরণার্থী বৃদ্ধ বেনারকে বলেন, “রাতে ঘর থেকে বের হতে ভয় লাগে। খুব আতংকের মধ্যে আছি। সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ রকম নিরাপত্তা তো সারা বছর দেওয়া হবে না।”

“মুহিব উল্লাহ হত্যার এক মাস পূর্ণ না হতেই একসঙ্গে ছয়জনকে মেরে ফেলা হয়েছে। ওরা দিন দিন খুব বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ভাবে দমন করা না হলে ভবিষ্যতে ক্যাম্পের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে মনে করেন তিনি।

“মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় প্রতিদিন ক্যাম্পে অভিযান হচ্ছে, যারা সরকারকে এ কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা তাদের টার্গেট করছে। একারণে এখন কেউ কিছু জানলেও বলার সাহস করছে না,” যোগ করেন এই রোহিঙ্গা নেতা।

তবে শরণার্থী শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে বলে বেনারের কাছে দাবি করেন রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান।

ওই মাদ্রাসাসহ আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকেও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, অপরাধীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চলছে।

মাদ্রাসা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান সিহাব কায়সার খান।

আরসার কর্মকাণ্ড ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে গেছে

“আরসা নামে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ক্যাম্পে নেই,” জানিয়ে সিহাব কায়সার খান বেনারকে বলেন, “তাদের নাম ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত করছে কিছু দুর্বৃত্ত।”

তবে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতি আছে। তবে সরকার এটি কৌশলগত কারণে স্বীকার করতে চায় না।”

তিনি বলেন, “আরসা যেসব কর্মকাণ্ড করেছে এবং করছে তা সবকিছুই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে গেছে, বাংলাদেশের বিপক্ষে যাচ্ছে।” 

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠন করতে কাজ করছে। মুহিব উল্লাহ ছিল তাদের নেতা। আরসার সদস্যরা তাঁকে হত্যা করেছে। আবার একটি মাদ্রাসা ছয়জনকে হত্যা করেছে আরসা যারা প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করছিল এবং ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে সহায়তা করছিল।

“আরসার এই কার্যক্রমগুলো প্রমাণ করে সংগঠনটির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যোগসূত্র আছে,” বলেন তৌহিদ হোসেন।

শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩০০ মাদ্রাসা ছাড়া তেমন কোনো স্কুল নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “এই মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ঘটছে। এই সহিংসতা কক্সবাজারসহ আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশে নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি হতে পারে।”

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে সরকারের অনুমোদন ছাড়া এতগুলো মাদ্রাসা কীভাবে গড়ে উঠল? এগুলোর ব্যাপারে আমাদের সিরিয়াসলি চিন্তা করতে হবে।

ক্যাম্পে ইইউ প্রতিনিধি দল

কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।

মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিশনার মি জানেজ লেনারসিকের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে বিভিন্ন শরণার্থী এবং সাম্প্রতিককালে শিবিরে সংগঠিত ঘটনার শিকারদের সাথে মতবিনিময় করেন।

এছাড়া প্রতিনিধিদলটি ইউনিসেফ পরিচালিত লার্নিং সেন্টারসহ কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শন করে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামছু দ্দৌজা নয়ন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।