রোহিঙ্গা শিবিরের কাছে অস্ত্র তৈরির কারখানা, তিনজন গ্রেপ্তার

সুনীল বড়ুয়া ও কামরান রেজা চৌধুরী
2021.11.08
কক্সবাজার ও ঢাকা
রোহিঙ্গা শিবিরের কাছে অস্ত্র তৈরির কারখানা, তিনজন গ্রেপ্তার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির সংলগ্ন পাহাড়ে অস্ত্রের কারখানা থেকে আটক রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাচ্ছেন র‌্যাব সদস্যরা। ৮ নভেম্বর ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবির সংলগ্ন পাহাড়ে অস্ত্র তৈরি কারখানার সন্ধান পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এসব অস্ত্রই শরণার্থী শিবিরে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার ভোরে র‌্যাবের ওই অভিযানে বিভিন্ন ধরনের ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনাস্থল থেকে তিন রোহিঙ্গা যুবককে আটক হয়েছে, পালিয়ে গেছে আরো কয়েকজন।

এই কারখানাটি কিছু সশস্ত্র রোহিঙ্গা যুবক নিয়ন্ত্রণ করত জানিয়ে কক্সবাজার র‌্যাবের অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বেনারকে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই সোমবার ভোর থেকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্প-৪ সংলগ্ন পাহাড়ে এই অস্ত্র কারখানায় অভিযান চালানো হয়।

“মাটির তৈরি গুদাম ঘরে অস্ত্র তৈরির কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে অস্ত্র তৈরির নানা সরঞ্জামও পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও সেখান থেকে ১০টি দেশে তৈরি অস্ত্রসহ তিন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আটক তিনজনই অস্ত্র তৈরির কারিগর,” বলেন খায়রুল ইসলাম।

“আমাদের ধারণা, এখানকার অস্ত্রগুলো সশস্ত্র রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করে,” বেনারকে বলেন সোমবারের অভিযানে অংশ নেওয়া কক্সবাজার র‌্যাবের উপ-অধিনায়ক তানভীর হাসান।

র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায় জানিয়ে তিনি বলেন, “উভয় পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে অন্তত চার ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। একপর্যায়ে তিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে ধরতে সক্ষম হলেও আর চার-পাঁচজন পালিয়ে যায়।”

তবে এই গোলাগুলির ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি বলে জানান তিনি।

২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার পর শরণার্থী শিবিরের পাশে অস্ত্র তৈরির কারখানা উদ্ধারের ঘটনা এটাই প্রথম বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় তারা বিভিন্ন দল, উপদলে বিভক্ত হয়ে এমনকি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ব্যানারে একত্রিত হয়ে ক্যাম্পে অস্ত্রের মহড়া চালাচ্ছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ‍হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। 

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির সংলগ্ন পাহাড়ে অস্ত্রের কারখানা থেকে উদ্ধার করা ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। ৮ নভেম্বর ২০২১। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির সংলগ্ন পাহাড়ে অস্ত্রের কারখানা থেকে উদ্ধার করা ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। ৮ নভেম্বর ২০২১। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

স্থানীয়দের জন্যও উদ্বেগের বিষয়

সরকারি হিসাবে, কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে ৩৫টি শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাস। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ক্যাম্পের ভিতরে অবৈধ ইয়াবা, অস্ত্র ব্যবসা এবং সেখানকার দোকান থেকে আসা চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ যাদের অনেকেই জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) এর সদস্য বলে পরিচর দেয়।

তবে বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি রয়েছে এমন কথা স্বীকার করতে চায় না সরকার।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে খুন হন রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মুহিব উল্লাহ, যাকে আরসা সদস্যরা হত্যা করেছে বলে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন।

ওই ঘটনার এক মাসের মধ্যে শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে একটি মাদ্রাসায় আক্রমণ চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে সশস্ত্র গ্রুপ। ওই ঘটনাও আরসা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পরিবারের সদস্যরা।

“রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অথবা ক্যাম্পের পাশে অস্ত্র তৈরির কারখানা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক,” বলে সোমবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের তেমন কাজ নেই। রোহিঙ্গা যুবকের একটি অংশ ইয়াবা, অবৈধ অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে লিপ্ত। এজন্য তাদের অস্ত্র দরকার।”

তাঁর মতে, বর্তমানে আগ্নেয়াস্ত্র অস্ত্র তৈরি করা “ডালভাতের মতো ব্যাপার।” 

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা যুবকদের একটি অংশ আরসার ব্যানারে কাজ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নব্বইয়ের দশকের জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) আবার মাথা চাঁড়া দিচ্ছে বলে সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককের বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা জানতে পারছি।”

“এর সাথে রয়েছে, ইসলামী মাহাস নামের আরেক সংগঠন,” যোগ করেন সাখাওয়াত হোসেন।

অং সান সূ চির উৎখাতকৃত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে আরএসও সমর্থন করলেও আরসা তাদের সমর্থন করে না বলে জানান তিনি।

“মূলত, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাবের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে মারামারি, খুনোখুনি চলছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশ। এদের কারণে বাংলাদেশে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করতে পারে,” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।

রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় অস্ত্রের কারখানা “শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, আমরা যারা স্থানীয় জনগোষ্ঠী আছি তাদের জন্যও উদ্বেগের বিষয়,” বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো. আয়াছুর রহমান।

“সম্প্রতি বড়ো দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল সেখানে। যেখানে রোহিঙ্গাদের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকেও তারা মেরে ফেলেছে। এর আগে এক যুবলীগ নেতাসহ অনেকে তাদের হাতে খুন হয়েছেন,” বলেন আয়াছুর রহমান।

“রোহিঙ্গারা যদি দিন দিন এভাবে বেপরোয়া হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে এই এলাকা ছাড়তে হবে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনতিবিলম্বে ক্যাম্পগুলোতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মূলোৎপাটন করা না হলে ভবিষ্যতে এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”

এদিকে সেপ্টেম্বরে মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ১৭০ জনের বেশি ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা শিবিরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর অধিনায়ক মো. নাইমুল হক।

মুহিব হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার ১১ জনের মধ্যে তিনজন হত্যাকাণ্ডে “জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দী দিয়েছেন,” বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।