বিক্ষোভের মুখে আটকে গেলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2018.11.15
ঢাকা ও কক্সবাজার
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
181115_Repatriation_1000.jpg কক্সবাজারের টেকনাফের উনচিপ্রাং ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গা বিক্ষোভ। ১৫ নভেম্বর ২০১৮।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গাদের সরব প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। এখনই মিয়ানমারে ফিরতে চাইছে না দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা ‘তালিকাভুক্ত’ প্রত্যাবাসীরা।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটি গাড়ি টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবিরে পৌঁছানোর পরই সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে ছিল তাঁদের।

সন্ধ্যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, “বাংলাদেশ জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাবে না। তবে শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য কতটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা জানতে প্রতিনিধি পাঠাবে বাংলাদেশ।

এর আগে বিকেলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। বিকেল চারটা অবধি অপেক্ষা করেছি আমরা।”

বাংলাদেশ ‘জোরপূর্বক’ কাউকে ফেরত পাঠাবে না উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাঁরা উদ্ভুত পরিস্থিতি জানিয়েছেন। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে প্রত্যাবাসন কমিশন।

এদিকে মিয়ানমার ফিরতে অনাগ্রহী রোহিঙ্গারা শরণার্থীদের যারা ফিরতে চায় তাঁদেরকে ভয় দেখিয়ে যেতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে।

গতকাল রাখাইনের রাজধানী সিত্তেতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “শরণার্থী শিবিরের যারা আসার আগ্রহ দেখিয়েছে, তাদের অনেককেই ভয় দেখানো বা মারধর এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।”

“এই পরিস্থিতির কারণে, অসংখ্য মানুষ যারা ফিরে আসতে চায়, তারা ভয়ে তা করতে পারছে না। এটা এই কারণে নয় যে, তারা আমাদের কথায় বিশ্বাস করে না, বরং অনেকেই আছে যারা আমাদেরকে বিশ্বাস করে,” বলেন আয়ে।

কারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায় তা ইউএনএইচসিআর এর যাচাই করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

‘ন যাইয়ুম, ন যাইয়ুম'

সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজারের ২২ নম্বর ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত টেকনাফের উনচিপ্রাং শিবিরে পাঁচটি বাস আর তিনটি ট্রাক ক্যাম্পে আসার পর সেগুলোকে ঘিরে ‘ন যাইয়ুম, ন যাইয়ুম' (যাব না, যাব না) স্লোগান তোলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, ভিটেমাটি ফিরে পাওয়াসহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ‘প্ল্যাকার্ড’ প্রদর্শন করে তারা। এছাড়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের বিচারের দাবি জানায়।

গত ৩০ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম দিনে এই ক্যাম্পের ৩০ পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পাঠানোর কথা ছিল।

এদের অধিকাংশই বুধবার রাত থেকে লাপাত্তা বলে দাবি করেছেন বিক্ষোভে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইউসুফ (৪০)। বেনারকে তিনি বলেন, “দাবি মানা না হলে আমরা ফিরে যাব না।”

দিনভর চেষ্টা করেও এই বিক্ষোভ থামাতে না পেরে ফিরে যান বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।

“প্রত্যাবাসনের জন্য উভয় দেশই প্রস্তুত ছিল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা (রোহিঙ্গারা) স্বপ্রণোদিতভাবে যেতে না চাইছে না” বেনারকে বলেন আরআরআরসি।

এদিকে প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার প্রেক্ষিতে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে উইন মিয়াত আয়ে বৃহস্পতিবার জানান, “সমস্ত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, আমি শুধু বাংলাদেশ পক্ষকে তা বাস্তবায়নে সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছি।”

“আমাদের দেশে অনেক ধরনের আইন রয়েছে। যারাই এখানে বসবাস করবে তারা দেশের আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে ও নিরপত্তা পাবে। তাঁরা (রোহিঙ্গা) এখানে নিরাপদে থাকবে,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গারা আজ না এলে, ভবিষ্যতে আসতে পারবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমার তাঁদেরকে গ্রহণ করার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত থাকবে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট এশিয়া সেন্টার এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এটা পরিস্কার যে রোহিঙ্গারা এত সহসা যাচ্ছে না। তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি বাংলাদেশের মাটিতে থাকবে।”

তাঁর ধারণা, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

এদিকে গত আগস্টে সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী অং সান সুচি এক বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার জন্য কার্যত বাংলাদেশকেই দায়ী করেন।

“কত দ্রুত এই (প্রত্যাবাসন) প্রক্রিয়া শুরু হবে তা নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর,” বলেন তিনি।

এরপরই মিয়ানমারের ভূমিকায় হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া সর্বশেষ ভাষণে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা মিয়ানমার মৌখিকভাবে বললেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না।”

সর্বশেষ জাতিসংঘ বলেছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরার পরিবেশ নেই। সংস্থাটি তাদের ফেরত না পাঠাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আর মিয়ানমার ঘোষণা দিয়েছে যে, ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবসান শুরু না হলে এর ব্যর্থতা বাংলাদেশের।

একজনও ফিরতে রাজি নয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া প্রতিবেদন প্রত্যাবাসনের অনুকূলে না বলে বৃহস্পতিবার সকালে জানিয়েছেন আরআরআরসি কালাম।

“তারা বলেছে, তালিকাভুক্ত একজনও এই মুহূর্তে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয়,” বলেন তিনি।

প্রত্যাবাসন কমিশন মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে মনোভাব জানতে ৪৮৫টি রোহিঙ্গা পরিবারের ২,২৬০ জনের একটি তালিকা ইউএনএইচসিআর-কে দিয়েছিল। গত ৩০ অক্টোবর দেওয়া ওই তালিকা ধরে গত মঙ্গলবার ও বুধবার (১৩ ও ১৪ নভেম্বর) ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তারা।

ইউএনএইচসিআর বুধবার সন্ধ্যায়ই আরআরআরসি-তে প্রতিবেদন জমা দেয়। মূলত এরপরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে ‘চূড়ান্ত সংশয়’ দেখা দেয়।

এ বিষয়ে মতামত জানতে বুধবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার বিকেল অবধি কোনও নির্দেশনা পাওয়া যায়নি বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছে প্রত্যাবাসন কমিশনার।

“ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে গোটা প্রক্রিয়া নিয়েই এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে,” বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা। তবে কালাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আশা ছাড়তে চাই না।”

রাজনীতি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “আমার ভয় হচ্ছে যে, এই রোহিঙ্গাদেরও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। নিজেদের বাসভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার কয়েক দশক পরও ক্যাম্পে জীবন কাটাচ্ছে তারা।”

“রোহিঙ্গারাও এমন এক জীবনে প্রবেশ করেছে। যদিও মিয়ানমার বলছে ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু তারা (রোহিঙ্গারা) আর ফিরে যাবে বলে মনে হয় না,” যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

প্রভাব ছিল না সীমান্তে

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের দেড়শ জনের প্রথম দলটিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পরিকল্পনা ছিল।

তবে সরেজমিনে ঘুমধুম সীমান্তে গিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পটিও ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে কয়েকজন বিজিবি সদস্যের টহল ছাড়া আর কিছু ছিল না।

প্রত্যাবাসন কমিশনারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারও তাদের অংশে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রেডিও ফ্রি এশিয়া থেকে মিন থেইন অঙ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।