মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ‘আশার আলো’ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা

কামরান রেজা চৌধুরী ও আব্দুর রহমান
2023.11.17
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ‘আশার আলো’ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে স্কুল শেষে ঘরে ফিরছে রোহিঙ্গা শিশুরা। ২৪ অক্টোবর ২০২৩।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে ‘আশার আলো’ দেখছেন গবেষক, বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা।

তাঁদের মতে, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে। ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে সামরিক জান্তা সরকার। আশান্বিত হওয়ার আরও দু’টি কারণ উল্লেখ করেছেন তাঁরা।

রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান মামলায় কানাডা ও ব্রিটেনসহ বিশ্বের ছয়টি প্রভাবশালী দেশ যুক্ত হয়েছে।

এছাড়া, গত বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় সর্বসম্মতিতে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন তারা।

প্রত্যাবাসন শুরু প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গারা তাঁদের ফেলা আসা ঘর-বাড়ি ফেরত চেয়েছেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন গবেষক আসিফ মূনীর। শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যা বিষয়ক মামলায় কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ছয়টি দেশের এক হয়ে কাজ করার ঘোষণা একটি ইতিবাচক এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।”

“রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে যে গণহত্যা পরিচালনা করা হয়েছে, সে বিষয়টি আদালতে আরও শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে,” বলেন তিনি।

আসিফ মূনীর বলেন, “আদালতে গণহত্যা প্রমাণিত হলে মিয়ানমারের সামরিক শাসকের ওপর ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হবে।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী এখন বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। সামরিক সরকার এখন বিপদে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে প্রত্যাবাসনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।”

আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারিক কার্যক্রমে ছয়টি দেশের অংশগ্রহণ ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।

তিনি বলেন, “আমাদের দেখতে হবে, এই ছয় দেশ মামলা পরিচালনার ব্যয় বহন করবে কি না। কারণ, আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা পরিচালনা করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যে কারণে ব্যয় বহন করা গাম্বিয়ার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল।”

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে আছে। তারা বিদ্রোহীদের কাছে হেরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো।

“মিয়ানমারকে বোঝানো যে, আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার বন্ধ হয়ে যাবে না। সুতরাং, তারা যত তাড়াতাড়ি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করবে—তাদের জন্যই ততই ভালো হবে।”

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এতে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারান, নারীরা ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বসতবাড়ি ফেলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে এমন অভিযোগ এনে ২০১৯ সালের নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। চার বছর পেরিয়ে গেলেও এই মামলার বিশেষ অগ্রগতি হয়নি।

আশাবাদী রোহিঙ্গারা

২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের সময় পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের সদস্য মোহাম্মদ তৈয়ুব।

শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, নিজ দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হব। সেদিন আর বেশি দূরে না। আমাদের ওপর চালানো গণহত্যার বিচার আদালতে হবে। প্রমাণিত হবে মিয়ানমার আমাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে।”

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জেলা শহর মংডুতে বাড়ি ছিল রমিদা বেগমের। ২০১৭ সালের হত্যাযজ্ঞে তিনি স্বামী ও এক বোনকে হারান। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন কুতুপালং ক্যাম্পে।

রমিদা বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকলে আমাদের নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরে যাওয়া সহজ হবে।”

এ ব্যাপারে আসিফ মূনীর বলেন, “একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের ঘৃণার মনোভাব রয়েছে। সেটি দূর না হলে প্রত্যাবাসন সফল হওয়া কঠিন। সে কারণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একটি রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।”

তিনি আরও বলেন, অং সান সূ চির দলের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত মিয়ানমারের বিদ্রোহী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট এর আগে বলেছে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করা এবং আন্তর্জাতিক আদালতকে সমর্থন প্রদান অব্যাহত রাখা। পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিকভাবে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করা। কারণ সামরিক শাসনের পতন হলে তারাই মিয়ানমারের বৈধ রাজনৈতিক শক্তি হবে।

01fcea4d-3c78-4653-ad37-09713d8b6ede.jpg
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের পরিচয় পত্র দেখিয়ে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা। ২৩ আগস্ট ২০২৩। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

প্রত্যাবাসন নিয়ে অগ্রগতি

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না। প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে। প্রত্যাবাসনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের দেওয়া রোহিঙ্গা তালিকায় থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয় ও ঠিকানা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে, অন্যথায় প্রত্যাবাসন হবে না।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে।

এছাড়া চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের সমন্বয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করে বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই কিছু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে।

সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর কক্সবাজার সফর করেছে মিয়ানমার সরকারের একটি প্রতিনিধি দল। তারা তালিকাভুক্ত আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের যে প্রতিনিধি দল এসেছিল, তারা রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করেছে। তবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে।”

মিজানুর রহমান বলেন, “প্রত্যাবাসন এখন যে জায়গায় আটকে আছে সেটি হলো, রোহিঙ্গারা তাদের ফেলে আসা বাড়ি-ঘরে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মিয়ানমার চায় তাদের কয়েকটি মডেল গ্রামে নিয়ে যেতে। রোহিঙ্গারা মডেল গ্রামে যেতে চায় না। প্রতিনিধি দল বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের কথাগুলো তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবে এবং তাদের নির্দেশ মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে আশাবাদ ব্যক্ত করে মিজানুর রহমান বলেন, “মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন নিয়ে যুক্ত আছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।