মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে পড়ছে আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শিশু

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2022.12.15
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে পড়ছে আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শিশু কক্সবাজারের টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা গত জুন মাস থেকে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম পড়ছে। ৭ ডিসেম্বর ২০২২।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম চালুর প্রথম বছরে পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের আওতায় এসেছে প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী।

ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের নেতৃত্বাধীন এডুকেশন সেক্টরের কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত বুলেটিনের তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন পাঠ্যক্রমটির আওতায় এসেছে দুই লাখ ৫৫ হাজার ৭৬ জন রোহিঙ্গা শিশু।

ইমেইলে দেওয়া বেনারের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) বাংলাদেশ কার্যালয় বলেছে, “আগামী বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে নথিভুক্ত সব শিশু মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী লেখাপড়া শিখবে। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এই শিক্ষা।”

“আমরা জানি রোহিঙ্গা শিশুরা লেখাপড়া শিখতে কতটা উদগ্রীব এবং ইউনিসেফ প্রতিটি শরণার্থী শিশুর শিক্ষার অধিকার পূরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” বেনারকে বলেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট।

এডুকেশন সেক্টরের তালিকাভুক্ত কক্সবাজারের স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটির (প্রান্তিক) মানবিক সহায়তা কর্মসূচীর সমন্বয় অনিমেষ বিশ্বাস অটল বেনারকে বলেন, “ইউনিসেফ ছাড়াও সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাকসহ কিছু স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা বিকল্প অর্থায়নে রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে কাজ করছে।”

এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও মিয়ানমারের পাঠক্রম চালু হচ্ছে উল্লেখ করে অটল জানান, কক্সবাজার ও ভাসানচরে তাঁদের পরিচালিত ১৪টি শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে ১১টিতে এখন মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম পড়ানো হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের নিজ দেশের পাঠ্যক্রমে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমার কারিকুলাম পাইলট প্রকল্প (এমসিপিপি) বাস্তবায়ন শুরু করে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ।

সরকারের পরামর্শে ইউনিসেফ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাইনুল কবির। তিনি বলেন, “আশ্রিত সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ আন্তরিক।”

“মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী, বিনামূল্যে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদানের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে,” যোগ করেন তিনি।

এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিশুরা লার্নিং কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাপ্রোচের (এলসিএফএ) আওতায় শিখছে, যা চার থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির সমমান শিক্ষা নিশ্চিত করছে।

সরেজমিনে শিক্ষাকেন্দ্র

কক্সবাজারের টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের একটি শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠদানকারী মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, গত জুনে সেখানে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম চালু হয়। এর আগে সেখানে ৮৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমটি চালুর পর সেখানে ১০৪ জন শিশু পড়াশুনা করছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেও জানান তিনি।

“নতুন পাঠ্যক্রমে শিশুরা খুশি, অভিভাবকরাও উৎসাহী,” বলেন এই রোহিঙ্গা শিক্ষক।

গত ৭ ডিসেম্বর সকালে ইউনিসেফ পরিচালিত ওই শিক্ষাকেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শতাধিক রোহিঙ্গা শিশুকে বর্মী ভাষায় গণিত বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। শিশুরা হাসিমুখে গভীর মনোযোগ দিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করছে। তাদের হাতে ছিল বিস্কুট। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তা খাচ্ছে।

একইদিন ওই ক্যাম্পের আরো দুটি শিক্ষাকেন্দ্রে একই চিত্রের দেখা মিলেছে। মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম চালুর পর শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সবাই বেশি খুশি। তাদের খুশির মাত্রা এমন যে, অবকাঠামো নিয়ে তাদের তেমন ভাবনা নেই। বেড়া দেওয়া ঘরে বসে লেখাপড়া করলেও মিয়ানমারের ভাষায় যে পড়তে পারছে, এতেই তারা যেন সন্তুষ্ট।

লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ওই শিক্ষাকেন্দ্রের ছয় বছর বয়সী শিক্ষার্থী নুর কামালের ভাষ্য, “নিজেদের ভাষায় পড়া শিখতে পারছি। এ জন্য আমরা খুব খু্শি।”

নতুন পাঠ্যক্রমে পড়বে সব শিশু

ইউনিসেফ বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, কক্সবাজার ও ভাসানচরে শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর মধ্যে চার লাখ ১০ হাজার শিশু স্কুলে যাওয়ার উপযোগী। এর ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ তিন লাখ ২৪ হাজার শিশু লেখাপড়া করছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে মোট তিন হাজার দুইশ শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে দুই হাজার ৮০০টি ইউনিসেফ ও তাদের অংশীদারদের মাধ্যমে পরিচালিত।

রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য মিয়ানমারের জাতীয় পাঠ্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত নতুন পাঠ্যক্রমের কথা জানিয়ে গত মে মাসে সরকার ও ইউনিসেফ পৃথক বিবৃতি দিয়েছিল। তখন তারা বলেছিল, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিশুরা লার্নিং কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাপ্রোচের (এলসিএফএ) আওতায় শিখছে, যা চার থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির সমমান শিক্ষা নিশ্চিত করছে।

“নতুন পাঠ্যক্রমটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণ করবে, সঙ্গে সঙ্গে এটা তুলনামূলকভাবে বয়স্ক শিশুদেরও শিক্ষা দেবে, যারা শিক্ষার সুযোগ থেকে অনেকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত রয়েছে,” গত ১ মে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল ইউনিসেফ।

পরে ৫ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এমসিপি ধীরে ধীরে এলসিএফএ-কে প্রতিস্থাপন করবে।

মার্কিন তৎপরতা বৃদ্ধির তাগিদ

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে আশ্রিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা এই শিশুদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন সিনেটররা।

মার্কিন সিনেটের পূর্ব-এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক বৈদেশিক সম্পর্ক উপকমিটি ৩০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএইড) প্রশাসক সামান্থা পাওয়ারকে পাঠানো চিঠিতে এই আহ্বান জানায়।

চেয়ারম্যান এডওয়ার্ডজে. মার্কিসহ উপকমিটির সিনেটররা বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ ও অংশগ্রহণ বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার এবং মানবিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা বাড়ালে সরকার ও ইউনিসেফের তৎপরতাও বাড়বে বলে মনে করেন ২০১৭ সালে উখিয়ার বালুখালী শিবিরে সপরিবারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিক্ষক রহমত উল্লাহ (৪০)।

বেনারকে তিনি বলেন, “শিবিরের সব শিশু মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে পড়ার সুযোগ পেলে আমাদের আগামী প্রজন্ম শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এটা খুব দরকার, কারণ রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার কারণে এখানে আসার অনেক আগে থেকেই শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে।”

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী নুর ফাতেমা (১৯) বেনারকে বলেন, “যেহেতু আমরা সবাই মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই, সে দেশের পাঠ্যক্রমে শিক্ষিত হওয়াটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।”

বন্ধ শিক্ষালয় বিতর্ক

রোহিঙ্গা শিবিরে শরণার্থীদের পরিচালিত শিক্ষালয়গুলো পুনরায় চালুর ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন সিনেটের ওই উপকমিটি।

মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে পরিচালিত ওইসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্তৃপক্ষ গত বছর বন্ধ করে দিয়েছে জানিয়ে চিঠিতে তারা বলেছেন, “শরণার্থীদের বাড়তি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার প্রচেষ্টাকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে বাংলাদেশ।”

মার্কিন সিনেটরদের চিঠির বিষয়ে ওয়াকিবহাল না থাকার কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মাইনুল কবির বেনারকে বলেন, “শিবিরে রোহিঙ্গাদের পরিচালিত মক্তব বা প্রাইভেট কোচিং সেন্টার বন্ধের বিষয়টি নিয়ে ইউনিসেফের সাথে একাধিক বৈঠকে আলাপ হয়েছে। শিক্ষাবাণিজ্য ও বৈষম্য ঠেকাতে তারাও আমাদের এই নীতির সঙ্গে একমত হয়েছে।”

এ বিষয়ে বেনারের প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট মেইলে বলেছেন, “জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুর মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যদের সঙ্গে অংশীদার হতে পেরে ইউনিসেফ গর্বিত। যারা এখনও স্কুলের বাইরে রয়েছে তাদের কাছে শিক্ষা পৌঁছানো ইউনিসেফের অগ্রাধিকার।

উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বর থেকে বন্ধ হওয়া ৩০টি স্কুল চালু করার দাবি জানিয়ে ২৮ এপ্রিল যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ(এইচআরডব্লিউ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ফর্টিফাই রাইটসসহ ২৫টি আন্তর্জাতিক সংগঠন।

মাইনুল জানান, সরকার শিবিরের ভেতরে যে কোনো প্রাইভেট কোচিং সেন্টার বা মক্তব পরিচালনাকে নিরুৎসাহিত করে, যেখানে অর্থের বিনিময়ে শেখার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

“শিশুদের বিনামূল্যে মানসম্পন্ন পাঠ্যক্রমে শিক্ষাদানের চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে তাদের মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। রোহিঙ্গা শিবিরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহদান শিক্ষাকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করবে,” মনে করেন মাইনুল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।