মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সাথে রোহিঙ্গাদের বৈঠক: আলোচনার ফল শূন্য
2019.12.19
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমার প্রতিনিধিদের সাথে রোহিঙ্গাদের তৃতীয়বারের বৈঠকেও প্রত্যাবাসন এবং দাবি-দাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তবে এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে দু’পক্ষই।
দুদিন ধরে সফররত মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার এ কথা জানান কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নেতারা।
মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকেও সাংবাদিকদের বলা হয়, রাখাইনে ফিরতে চাইলেও অনেক বেশি শর্ত আরোপ করছে রোহিঙ্গারা।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা মো. ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা শুরু থেকেই মিয়ানমারের কাছে আমাদের নাগরিকত্ব, রোহিঙ্গা হিসাবে স্বীকৃতি, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা এবং নিজেদের ভিটে-বাড়িতে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি।”
“গত দুদিনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও ফলাফল শূন্য। কোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা বরাবরের মতো হতাশ,” বলেন তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন বেনারকে বলেন, “এ বৈঠক থেকে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না আসলেও এ আলোচনা অব্যাহত রাখতে সবাই সম্মত হয়েছে।”
মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনৈতিক বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল চ্যান অ্যায়ে।
বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বৈঠকে আমরা রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছি। রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের অবস্থার উন্নতি করতেই আমাদের এ প্রয়াস।”
“এখন সবকিছু নির্ভর করছে তাঁদের সিদ্ধান্তের ওপর,” উল্লেখ করে চ্যান অ্যায়ে বলেন, এটা কোনো রাজনৈতিক সংলাপ নয়। রাখাইনের পরিস্থিতি বদলাতে আলোচনা মাত্র। আমরা তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) উদ্বেগগুলোও জানতে চাই।”
“আমরা তাঁদের কথা শুনেছি। রাখাইনে ফিরতে চাইলেও তাঁদের কিছু শর্ত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি খুবই উচ্চমানের,” বলেন তিনি।
তাঁদের রাখাইনে সফর করানোর কথাও বলেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের প্রধান।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে দুই দিনের সফরে কক্সবাজার আসেন মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ের নয় সদস্য। তাঁদের সাথে আসিয়ানের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলও রয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উইন মিয়াট আয়ে’র নেতৃত্বে এবং চলতি বছরের ২৭ ও ২৮ জুলাই মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ে’র নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ও আসিয়ান প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেসব বৈঠকও শেষ হয় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা সেলের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার আমাদের বলেছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি করাতে তাঁদের সাথে তথ্য বিনিময় করাই এই প্রতিনিধিদলের উদ্দেশ্য।”
“তারা পরপর দুই দিন রোহিঙ্গাদের সাথে বৈঠকে বসেছিল। আজ রাতে আমাদের সাথে বসবে। আমরা মূলত তাদের কাছ থেকে ফিডব্যাক জানব। এরপর এ বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ তাদেরকে জানাব,” বলেন তিনি।
ধোঁকা দিচ্ছে মিয়ানমার
প্রতিনিধিদলের সফরের মাধ্যমে মিয়ানমার বিশ্ববাসীকে নিছক ‘ধোঁকা’ দিতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে চাইলে মিয়ানমারকে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার বিশ্বকে ধোঁকা দিতে চাইছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক আদালতে একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার শুনানি শেষে রায়ের অপেক্ষায় আছে সারা বিশ্ব। সেই রায়কে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে মিয়ানমার নিজেদের অসৎ বুদ্ধি প্রয়োগ করে একটা প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে পাঠিয়েছে।”
“এর মাধ্যমে তারা বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে উৎসাহী এবং তারা সে কাজ করে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের মতে, “এই ধরনের প্রতিনিধি পাঠিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। মিয়ানমারকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, আমরা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবো এবং তাদের সংবিধানে এ জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে।”
পুরোনো প্রস্তাব নতুন করে
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দফা বৈঠকে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের কাছে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ, সেক্রেটারি ছৈয়দ উল্লাহসহ রোহিঙ্গা নেতারা।
মুহিব উল্লাহ বেনারকে বলেন, “দুদিন ধরে আমরা সেই পুরনো বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলেছি। আমরা আমাদের দাবিগুলোর কথা বলেই যাচ্ছি, কিন্তু সেই পুরোনো প্রস্তাবগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের বলছে মিয়ানমার।”
“তবে আমরা গতবারের মতো এবারও বলেছি নাগরিকত্বসহ অন্তত তিনটি দাবি পূরণ না হলে আমরা ফিরে যাব না,” বলেন তিনি।
“মনে হচ্ছে এই বৈঠকেও কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না। যে কারণে আমরা হতাশ। তবুও আমরা আলোচনা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছি। তারাও এ বিষয়ে সম্মত আছে,” যোগ করেন মুহিব।
রোহিঙ্গা নেত্রী জমাআলীদা বেনারকে বলেন, “তাঁরা বলেছে, আমাদের আগে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) দিয়ে রাখাইনে নিয়ে কিছুদিন ক্যাম্পে রাখবে। তারপরে নিজেদের বাড়ি-ঘরে নিয়ে যাবে। আমরা তাদের এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।”
হিন্দু শরণার্থীদের সঙ্গে বৈঠক
রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এ মিয়ানমার থেকে আসা ১৫ জন হিন্দু প্রতিনিধির সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
এ সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে বিনা শর্তে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা জানান হিন্দু শরণার্থীরা।
বৈঠকে অংশ নেওয়া হিন্দু শরণার্থী শিবিরের মাঝি শিশু শীল (৩০) বেনারকে বলেন, “আমরা গতবারও তাদের বলেছি, আমরা ফিরে যেতে চাই। আমাদের কোনো দাবি নেই, শুধু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাই।”
“আমাদের ওপর কোনো গোষ্ঠী নির্যাতন করবে না এই নিশ্চয়তা পেলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব,” বলেন শিশু শীল।