তিন সপ্তাহ ধরে আন্দামানে ভাসছে শরণার্থী নৌকা, জরুরি উদ্ধারের আহ্বান

কামরান রেজা চৌধুরী ও আব্দুর রহমান
2022.12.20
ঢাকা ও কক্সবাজার
তিন সপ্তাহ ধরে আন্দামানে ভাসছে শরণার্থী নৌকা, জরুরি উদ্ধারের আহ্বান সমুদ্র থেকে ১০৪ জন রোহিঙ্গা বহনকারী একটি নৌকা উদ্ধার করে তীরে আনার পর এক শরণার্থী শিশুকে পানি খাওয়াচ্ছেন শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনীর সদস্যরা। ১৮ ডিসেম্বর ২০২২।
[ছবিটি শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট থেকে নেয়া]

আন্দামান সাগরে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে নারী-শিশুসহ প্রায় দুইশ রোহিঙ্গা নিয়ে আটকে পড়া ট্রলারটি জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশের সংসদ-সদস্যদের সংগঠন পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এপিএইচআর)।

মঙ্গলবার জাকার্তাভিত্তিক সংগঠনটির বোর্ড সদস্য ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক সদস্য ইভা সুন্দরী সংগঠনের পক্ষে এই আহ্বান জানান।

তবে ওই ট্রলারটিতে রোহিঙ্গা ছাড়াও প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা।

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সহায়তায় বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে সাগর পথে প্রায় ১৫০ জন রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন টেকনাফের স্থানীয় প্রায় ৫০ যুবক। নভেম্বরের শেষ দিকে ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রলারটি সাগরে ভাসতে থাকে।

বেনারের পক্ষ থেকে সরেজমিন টেকনাফ থেকে ৫০ যুবকের পরিচয় পাওয়া গেছে, যাদের প্রায় সবাই একই এলাকার বাসিন্দা।

এদিকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত ৮ ডিসেম্বর সাগরে আটকে পড়া হতভাগা ব্যক্তিদের উদ্ধার করার আহ্বান জানালেও আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনও উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

সংস্থাটির আশঙ্কা, ইতোমধ্যে হয়তো অনেক ব্যক্তি খাদ্য ও পানীয় না পেয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এবং যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা চরম অনাহারে রয়েছেন।

“আসিয়ান সদস্যভুক্ত সব রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের অতি জরুরি আহ্বান; আপনাদের জলসীমায় প্রবেশ করলে মানবিক দায়িত্বের জায়গা থেকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করুন এবং এই শরণার্থীদের নৌকা থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন,” বিবৃতিতে বলা হয়।

এতে আরও বলা হয়, “এসব পুরুষ, নারী ও শিশুদের বহনকারী নৌকা সাগরে ভাসতে দিয়ে তাঁদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। নৌকায় অবস্থানকারী মানুষদের অবহেলা করা মানবতাকে অবমাননা করার সামিল।”

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে সংস্থাটি বলছে, এর আগে ৮ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা শরণার্থী বোঝাই একটি নৌকায় আটকে পড়া ১৫৪ জনকে উদ্ধার করে ভিয়েতনামের তেলবাহী জাহাজ।

এছাড়া ১৮ ডিসেম্বর ১০৪ জন শরণার্থী বহনকারী আরেকটি নৌকা উদ্ধার করে শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের নৌকা সাগরে আটকে পড়ার ব্যাপারে তেমন কিছু অবহিত নয় বলে জানিয়েছে।

ট্রলারে থাকা স্কুলছাত্রের অডিও ক্লিপ

টেকনাফ থেকে বেনার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা ট্রলারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ছাড়াও কয়েকজন স্থানীয় বাংলাদেশী যুবক রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই টেকনাফ অঞ্চলের বাসিন্দা।

আটকে পড়া ট্রলারে অবস্থান করা স্কুলছাত্র মোহাম্মদ মিজান শুক্রবার মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী চাচাতো ভাই মো. তারেককে ফোন করে ট্রলারটিকে উদ্ধারের আবেদন জানিয়ে বলেন, তারা হয়তো আর বাঁচবেন না।

তারেক সেই অডিও ক্লিপটি টেকনাফে তাঁর পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

টেকনাফের হাবিরছড়ার বাসিন্দা মিজানের সেই ভয়েসটি শুনে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

ওই কথোপকথনের অডিও ক্লিপ বেনারের হাতে এসেছে। পরিবারের সদস্যরেই অডিও ক্লিপটি দিয়েছেন।

ক্লিপে মিজানকে বলতে শোনা যায়, “পাঁচ দিন ধরে লোনা পানি খেতে হচ্ছে। পারলে আমাদের উদ্ধার করতে বইলেন। না হলে আমার কুলখানি করে ফেলতে বলিও। আর হয়তো একদিন বাঁচব। কারণ ট্রলারে খাওয়ার জন্য কিছু নেই; শুধু সাগরে লোনা পানি ছাড়া।”

“আমরা এখন ভারতের আন্দামান সাগরে কাছাকাছি আছি। এখানে ভারতীয় নৌবাহিনী আশেপাশে আছে। তবে তারা কিছু করছে না,” বলেন মিজান।

টেকনাফে হাবিরছড়ার বাসিন্দা নুর বাহার বেনারকে জানান, “১৬ দিন পর জানতে পেরেছি, আমার স্কুল পড়ুয়া ছেলে মিজান সাগরে ভাসমান ট্রলারে আটকা পড়েছে। সে কীভাবে সেখানে পৌঁছেছে তা আমরা জানি না।”

তিনি বলেন, “এলাকায় আরও কিছু যুবকের সাথে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল। এখন তাদের ট্রলার নষ্ট হয়ে সাগরে ভাসছে।”

ট্রলারে ৫০ বাংলাদেশি

আন্দামান সাগরে আটকে পড়া ট্রলারটি উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা ছাড়াও প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা।

ট্রলারে থাকা বাংলাদেশি যুবকদের বেশিরভাগই টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া বাসিন্দা। সাগরে ভাসমান ট্রলারে থাকা একাধিক যুবকের পরিবারের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়াসহ পাশের দরগারছড়া, মিঠাপানিরছড়া, রাজারছড়া গ্রাম এসব যুবকদের ঠিকানা। 

টেকনাফের হাবির ছড়ার ইউপি সদস্য মোহাম্মদ রশিদ বেনারকে জানান, “সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে ট্রলারে আটকে পড়া তার এলাকার প্রায় ৫০ জন বাসিন্দা রয়েছে, যাদের বয়স ১৮-২২ বছর। তাদের পরিবার কান্নাকাটি করছে।”

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. কবির মঙ্গলবার বেনারকে জানান, “আমার ছেলে আকতার ফারুক (১৭) এ মাসের শুরুতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দুই তিনদিন পর বন্ধুবান্ধবদের কাছে খবর পাই, তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ট্রলারে উঠেছে।”

তিনি বলেন, “তিনদিন আগে মালয়েশিয়ায় থাকা এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ছেলে খবর পাঠিয়েছে যে, তাদের বহন করা ট্রলারটি সাগরে বিকল হয়ে পড়েছে।”

ট্রলারে অবস্থানকারী আরেক যুবক মোহাম্মদ ইউনুসের (২০) পিতা নুর আহমেদ জানান, “মো. হোসেন নামে এক দালালের মাধ্যমে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া রওনা দিয়েছে ইউনুস। এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছি।”

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “সাগরে ভাসমান মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে থাকা লোকজনের পরিবারের কাছ থেকে বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডকে অবগত করা হয়েছে। আমরা ট্রলারটি কোন জায়গায় রয়েছে সেটি জানার চেষ্টা করছি।”

এদিকে আন্দামান সাগরে ভাসমান নৌকাটিকে উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কি না জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও নৌবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।