নিয়ন্ত্রণহীন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়াতে পারে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি
2016.12.23
মিয়ানমারের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি উসকে দিতে পারে। পুলিশ ও প্রশাসন এই আশঙ্কা করছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপও এর সাম্প্রতিক প্রকাশনায় একই ঝুঁকির কথা জানিয়েছে।
‘মিয়ানমার: অ্যা নিউ মুসলিম ইনসারজেন্সি ইন রাখাইন স্টেট’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী হারাকা আল ইয়াকিনের সদস্যদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, দলটির নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের কোনো কোনো অংশের শক্ত যোগাযোগ আছে।
হারাকা আল ইয়াকিন (এইচএওয়াই) সুসংগঠিত জঙ্গি গোষ্ঠী। তাঁদের বিদেশি প্রশিক্ষণ ও বেশ মোটা অঙ্কের তহবিল আছে। ধারণা করা হয়, সৌদি আরব থেকে অর্থের একটা ভালো জোগান তারা পেয়ে আসছে। ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার বহু রোহিঙ্গা সৌদি আরবে আছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সাল থেকেই বিভিন্ন সময় ভেঙে ভেঙে রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। কুতাপালং ও নোয়াপাড়ায় ৩৩ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী থাকলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বাংলাদেশে তিন থেকে পাঁচ লাখ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আছেন।
বাংলাদেশে সরকারের উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা জানতে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় যে শুমারি অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা শেষ হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক আর থাকবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ১২ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলা ও ৯ নভেম্বর কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা খুন হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ওঠে। রোহিঙ্গারা দলে দলে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত ২০ ডিসেম্বর এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে জঙ্গিবাদে জড়াতে না পারে এবং তাদের যাতে কেউ বিভ্রান্ত করতে না পারে সে জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কক্সবাজারে সক্রিয় রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ যা বলছে
এইচএওয়াই এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে কি না সে ব্যাপারে তাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে থাকলেও তাতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ কয়েক দশক ধরেই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল।
আর এই প্রশিক্ষণের কাজটি হয়েছে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশে। তবে এইচএওয়াই প্রকাশ্যে যা বলছে, বা তাদের যে কর্মকাণ্ড তা থেকে মনে হয় এখন পর্যন্ত তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মিয়ানমারের নিরাপত্তারক্ষীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা শরণর্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে না দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত জঙ্গি দমন অভিযান বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাঁরা বলছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এই সঙ্কট সৃষ্টি করলেও তা বাংলাদেশে নতুন জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি স্থানীয়দের সহানুভূতি তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া ওই জঙ্গিগোষ্ঠী মিয়ানমারের শান্তি ও স্থিতিশীলতায়ও বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণের উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। তাঁরা নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁদের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের খুব ভালো যোগাযোগ আছে। মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে, তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছেন এইচএওয়াই এর নেতৃবৃন্দের প্রশিক্ষণ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ইস্যুটিকে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। যেমন তেহরিক ই তালিবান, পাকিস্তান ভিত্তিক লস্কর ই তাইয়্যেবা, ভারতীয় উপমহাদেশে আল কায়েদার সংগঠন একিউআইএস।
প্রতিবেদনে আইএসের মুখপাত্র দাবিকের এপ্রিল সংখ্যায় আবু ইব্রাহীম নামে একজন বাংলাদেশিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, আইএস মিয়ানমারের মুসলিমদের রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ লেনদেনের একটা বিষয় থেকে থাকতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে আঞ্চলিক অস্ত্র চোরাচালানকারী গোষ্ঠী, বাংলাদেশি বা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমার ভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী যোগাযোগ রাখতে পারে। তবে, মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীতে অ-রোহিঙ্গা যোদ্ধার উপস্থিতির কোনো খবর নেই।
পুলিশ সদর দপ্তরে কাউন্টার টেররিজমের ফোকাল পয়েন্ট ও সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ জঙ্গিবাদ উসকে দিতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ খুব সতর্কতার সঙ্গে নিতে হচ্ছে।”
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে এমন একটি অঞ্চলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেছেন, ভৌগোলিক কারণে পাহাড় ও সমুদ্র তীরবতী অঞ্চলটি খুব স্পর্শকাতর। এ এলাকায় লম্বা সময় ধরে পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে একটা বিরোধ চলে আসছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই সহানুভূতি কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার একটা চেষ্টা হতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “ধর্মীয় অনুভূতি মানুষকে বিবেক বিবেচনাবোধশূন্য করে তোলে। ধর্মের কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে অন্য অঞ্চলে থাকা ওই ধর্মের মানুষ প্রভাবিত হতে পারেন, হচ্ছেনও।”
বেসরকারি সংস্থার ইচ্ছেমতো যাতায়াত নিষিদ্ধ
নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে দেশি বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর সরাসরি যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বিতর্কিত বা অনিবন্ধিত এনজিওর ত্রাণ বিতরণে যুক্ত হওয়ার খবর জেলা প্রশাসনের কাছে নেই।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকারের অবস্থান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো। কিন্তু ইতিমধ্যে বেশ বড় সংখ্যায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে।”
সরকারের ওই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা হচ্ছে। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি নির্দেশ আছে, জেলা প্রশাসনের মাধ্যমেই ত্রাণ পৌঁছাতে হবে।
“রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দেওয়ার সরকারি নীতি আসলে তাদের প্রবেশ ঠেকাতে পারবে না। এ দেশের কট্টর ইসলামি গ্রুপ হেফাজত–ই–ইসলাম ত্রাণ দেওয়াসহ নানাভাবে তাদের সহায়তা করছে,” বেনারকে জানান রোহিঙ্গা ইস্যু ও অভিবাসন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির।
তাঁর মতে, কট্টরপন্থি ওই ইসলামি গ্রুপটি মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের সহজে ব্যবহার করতে পারে। তা ছাড়া রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবকেরা যেভাবে এ দেশে আসছে তাতে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ ও ব্যবহার করা হতে পারে।
“আমাদের রোহিঙ্গা ভাইয়েরা ধর্মবিশ্বাসের কারণে সেখানে হত্যা ও নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন। মুসলিম বোনেরা ধর্ষিত হচ্ছেন। সেখানকার সরকার নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। তাই মানবতা ও ধর্মের কারণে হেফাজতে ইসলাম অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে,” বেনারকে জানান হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন রুহি। তবে তিনি দাবি করেন, তাঁদের সংগঠন যে কোনও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।
লেখক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, ২০০৭ সালে তিনি জঙ্গি রোহিঙ্গা নেতাদের সাক্ষাতকার নিতে মিয়ানমার গিয়েছিলেন। তাঁরা তখন তাঁকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলামি দল তাঁদের সহায়তা করে থাকেন।
শাহরিয়ার কবীর বলেন, ২০০৭ সালে যে ১৭টি জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পাওয়া যায়, সেগুলোর বেশিরভাগেরই নেতৃত্বে ছিলেন রোহিঙ্গা নেতারা। সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
এই প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী