এক রোহিঙ্গার বিবরণে সাগরে ভাসার ভয়াবহ স্মৃতি
2022.12.27
জাকার্তা
মুহাম্মদ তাহের (৩৮) যখন একটি জরাজীর্ণ নৌকায় চড়ে ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তিনি জানতেন, জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। কিন্তু পরিবারের একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য মরিয়া ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ভবিষ্যৎহীন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ঝুঁকি মেনে নেওয়াই উত্তম ভেবেছিলেন তিনি।
১৮০ জনেরও বেশি লোক নিয়ে নৌকাটি যাত্রা করার এক সপ্তাহ পরে এর ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। যাত্রীরা তখন পলিথিন দিয়ে একটি অস্থায়ী পাল বানিয়ে নৌকাটি চালানোর চেষ্টা করেন। ধীর গতির নৌকায় খাবার এবং পানি কয়েকদিনেই ফুরিয়ে যায়। ক্ষুধার্ত এবং জলশূন্য যাত্রীরা তখন বাধ্য হয়ে সমুদ্রের জল পান করতে শুরু করেন।
টেলিফোনে বেনারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাহের বলেন, “অনাহারে তৃষ্ণায় যাত্রীরা একের পর এক মরতে শুরু করল। এভাবে আমরা ২০ জনকে হারালাম।”
“নৌকায় এত মানুষ গাদাগাদি করে ছিল যে, আমাদের শোয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সবাইকে দিনের পর দিন বসে থাকতে হয়েছে,” বলেন তিনি।
প্রায় এক মাস সমুদ্রে ভেসে সোমবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের পিডি জেলায় অবতরণ করা ১৭০ জনের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে একজন তাহের। আগের দিন ৫৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে আরেকটি নৌকা আচেহের অন্য একটি উপকূলে পৌঁছেছিল।
একজন স্থানীয় বাসিন্দার শেয়ার করা একটি ভিডিওতে সোমবার নারী ও শিশুসহ ১৮৫ জন অভ্যাগত রোহিঙ্গাকে সমুদ্র সৈকতে দুর্বল, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও অবস্থায় দেখা গেছে। বেদনাদায়ক ফুটেজে ভিড়ের মধ্যে কয়েকজনকে কান্নাকাটি করতে শোনা যায়।
‘যেদিকে তাকাই, শুধুই সমুদ্র’
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) সোমবার সর্বশেষ ইন্দোনেশিয়ায় আগত শরণার্থীর সংখ্যা ১৮৫ থেকে সংশোধন করে ১৭৪ ঘোষণা করেছে। এই দলে ১০৭ জন শিশু রয়েছে।
তাহের বলেন নৌকা আচেহের তীরে পৌঁছানোর আগে তাঁরা ৩৫ দিন সমুদ্রে ছিলেন।
“আমরা যেদিকে তাকাই, শুধুই সমুদ্র,” বলেন তিনি।
তিনি তাঁর স্ত্রী এবং চার সন্তানকে কক্সবাজারে রেখে গেছেন, যেখানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করেন।
“আমার ইন্দোনেশিয়া আসার উদ্দেশ্য ছিল, কারণ আমি এখানে কাজ করতে পারব” উল্লেখ করে তাহের বলেন,” পরিবারকে ক্যাম্পে রেখে এসেছি; আমার বাচ্চারা এখনও ক্যাম্পে পড়াশোনা করছে।”
বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় আছে শিশুরাও
প্রতি বছর শত শত রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে পালানোর চেষ্টায় বিপজ্জনকভাবে সমুদ্র পাড়ি দেন। কারণ তাঁরা নিজ দেশ মিয়ানমারে ভয়াবহভাবে নির্যাতিত। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে কষ্টকর বেকার জীবন কাটানোর পরিবর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উন্নত জীবন ও জীবীকার সন্ধানে দূর দেশে যাওয়াকে তাঁরা শ্রেয় মনে করেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই সর্বশেষ দলটির পলায়ন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে মিয়ানমারের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরের কঠোর পরিস্থিতি তুলে ধরে।
ইন্দোনেশিয়ায় অ্যামনেস্টির নির্বাহী পরিচালক উসমান হামিদ বলেছেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য আঞ্চলিক সরকারগুলোর তাৎক্ষণিক ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে এখনও বহু মানুষ ভগ্ন নৌযানগুলিতে প্রাণ হারাতে পারে। এটি অগ্রহণযোগ্য।”
“সাগরপথে বিপজ্জনক যাত্রা করা রোহিঙ্গাদের জন্য এই বছরটি সাম্প্রতিক স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হতে পারে,” আশঙ্কা করেন তিনি ।
উসমান ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা এবং সমুদ্রে ভাসমান ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “কোনো পরিস্থিতিতেই কর্তৃপক্ষ কাউকে যেন এমন দেশে ফেরত না পাঠায়, যেখানে তাঁরা নিপীড়ন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্মুখীন হতে পারে।”
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় আচেহ প্রদেশে পৌঁছানো এই সর্বশেষ নৌকাটি এক সপ্তাহের ব্যবধানে পৌঁছানো দ্বিতীয় নৌকা। গত বড়দিনে কাঠের নৌকায় চড়ে ৫৭ রোহিঙ্গা পুরুষ আচেহ বেসার রিজেন্সিতে পৌঁছেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য অনুসারে তাঁদের মধ্যে ১৩ জন শিশু ছিল।
মালয়েশিয়ার একটি মানবাধিকার সংগঠন গিউটানিও ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং আন্তর্জাতিক পরিচালক লিলিয়ান ফ্যান বলেছেন, “হ্যাঁ, সর্বশেষ পৌঁছানো এই নৌকাটি সেই নৌকা যা উদ্ধারের জন্য আমরা কয়েক সপ্তাহ আগে আহ্বান জানিয়েছিলাম।”
সাগরে আরো শরণার্থী নৌকা থাকতে পারে
সম্প্রতি জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন এনজিও মানুষ-পাচারকারী নৌকা এবং এমন বিপজ্জনকভাবে অবৈধ যাত্রার চেষ্টাকারী শরণার্থীদের সন্ধান এবং উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এই অঞ্চলের সরকারগুলোকে চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
পিডিতে আসা এই নৌকায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি আছেন কিনা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত সপ্তাহে কক্সবাজারে বেনারের সাথে সাক্ষাতকারে এই অভিবাসীদের মধ্যে থাকা কয়েকজন বাংলাদেশির স্বজনরা তাঁদের সন্তানদের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
পিডির পুলিশ প্রধান পাডলি বলেছেন, কর্তৃপক্ষ আরও শরণার্থী নৌকার অনুসন্ধান করছে।
“বর্তমান পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল থাকায় জেলেরাও রোহিঙ্গাদের নৌকা খুঁজতে সাগরে যাচ্ছেন না,” বেনারকে বলেন তিনি।
স্থানীয় এনজিও আসর হিউম্যানিটি আচেহ-এর স্বেচ্ছাসেবক রিজাল ফাহমি বলেছেন, অনেক শরণার্থীর অবস্থা “উদ্বেগজনক”।
বেনারকে তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে অনেকেই দুর্বল হয়ে পড়ে আছে এবং তাদের শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। খাদ্য ও পানীয়হীন অবস্থায় অনেকদিন সাগরের মাঝখানে থাকায় তাঁদের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে।”
আইওএম ইন্দোনেশিয়ার মুখপাত্র আরিয়ানি হাসানাহ সোয়েইতি বলেছেন, তাঁর সংস্থা একটি জরুরি সহায়তা দল পাঠিয়েছে। তারা বর্তমানে স্থানীয় সরকারের সাথে যৌথভাবে শরণার্থীদের স্বাস্থ্যের দেখভাল করছে।
“প্রাথমিক রিপোর্টে বোঝা যায়, তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন,” বেনারকে বলেন তিনি।
সংস্থাটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা, যথাযথ অস্থায়ী আবাসন, জল এবং শরণার্থীদের জন্য স্যানিটেশন প্রদানে সহায়তা করছে, আরিয়ানি বলেন।
এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে তারা “১৮০ জন রোহিঙ্গাসহ আরেকটি নৌকা সাগরে নিখোঁজ হওয়ার অসমর্থিত প্রতিবেদন পেয়েছে।”
ইউএনএইচসিআরের আঞ্চলিক মুখপাত্র বাবর বালোচ বেনারকে বলেন, “নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন এবং সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ভিত্তিতে আমাদেরকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।”
তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ১৮০ জন যাত্রী নিয়ে সম্ভাব্য ডুবে যাওয়া নৌকাটি সম্প্রতি আচেহ প্রদেশে আসা নৌকাগুলো থেকে ভিন্ন।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, ২০২২ সালে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর হয়ে মানবপাচারকারীদের মাধ্যমে ছোট ছোট নৌকায় সমুদ্রযাত্রা করেছেন, যাদের মধ্যে আনুমানিক ২০০ জন মারা গেছেন।
গত ছয় সপ্তায় ইন্দোনেশিয়া সমুদ্রপথে আসা প্রায় ৫০০ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার ও সুরক্ষা দিয়েছে বলেও জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ছেড়ে সমুদ্রপথে বিপজ্জনক যাত্রা রোধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান।
এই উদ্দেশ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি বাড়ানো ছাড়াও শরণার্থী নেতাদের মাধ্যমে সবাইকে এ ধরনের যাত্রার বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জাকার্তা থেকে এরি ফিরদৌস।