মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আহবান
2016.12.29
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশি জেলেদের নৌকায় মিয়ানমার নৌবাহিনীর গুলি করার ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে এদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বলেছে। এর পাশাপাশি গত কয়েকমাস ধরে রোহিঙ্গাদের সেদেশ থেকে আসা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এই নিয়ে গত পাঁচ সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করল ঢাকা। এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ২৩জন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
দেশটির রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে নিরুপায় হয়ে প্রতিদিনই নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। তাদের অনেককেই আবার ফেরত পাঠাচ্ছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি।
এই ইস্যুতে চাপ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশকে আরো জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। এ সমস্যা সমাধান ছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে্ও মনে করেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাদ দিয়ে দুদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এটা মানবিক সমস্যা, যা এখন আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে।”
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “এই সংকট সমাধানে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ আসিয়ান দেশগুলো যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, বাংলাদেশ ততটা নেয়নি। যেহেতু আমরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেহেতু আরেকটু উদ্যোগ নেওয়া যেত কিনা সেটা চিন্তা করা যেতে পারে।।”
তবে মিয়ানমারকেও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে মর্মে- তিনি বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত না মিয়ানমার সমাধানের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে উদ্যোগ না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাধানের পথ দেখা যাচ্ছে না।”
এদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নতুন আরো কয়েকটি ক্যাম্প নির্মাণ করার কথা জানিয়েছে বিজিবি।
দুদেশের মধ্যকার ১১০ কিলোমিটার সীমান্ত এখনো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “সীমান্ত সুরক্ষায় আরো কয়েকটি নতুন ক্যাম্প নির্মাণ করবে বিজিবি।”
রাষ্ট্রদূতকে তলব, রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার আহবান
গত ২৭ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশি মাছ ধরার ট্রলারে গুলি চালায় মিয়ানমারের নৌবাহিনী। এতে গুলিবিদ্ধ হন ছয়জন জেলে। আহত একজনসহ বাংলাদেশি জেলে ও তাদের মাছধরা নৌকা নিয়ে যায় তারা। প্রায় চার ঘণ্টা পরে জেলেদের জিনিসপত্র রেখে আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া হয়।
এরই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তও দাবি করা হয়।
একইসঙ্গে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নির্যাতনের শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কোন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরুর আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় ও কনস্যুলার) কামরুল আহসান বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে পালিয়ে আসা ও আগে থেকে অবস্থান করা সকল রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত নিতে বলা হয়েছে। সেটা কোন প্রক্রিয়ায় হতে পারে, সে বিষয়ে আলাপ করতে বাংলাদেশ আগ্রহী।”
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “গত ৯ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া তিন লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী আগে থেকেই বাংলাদেশে বসবাস করছে।”
বিশেষ দূত পাঠাবে মিয়ানমার
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশে একজন বিশেষ দূত পাঠাচ্ছেন মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেত্রী অং সান সুচি।
পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হককে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হাজার-হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা মূল্যায়নের জন্য অং সান সূচি'র বিশেষ দূত শিগগির বাংলাদেশ সফর করবেন।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, “যদি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সত্যিকার অর্থেই সমস্যা সমাধানের জন্য সুচি দূত পাঠান, তাহলে খানিকটা আশাবাদি হওয়া যায়। তবে এটা যদি রুটিন কূটনৈতিক কাজের অংশ হয়, তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কম।”
জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি
এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ২৩ বিশিষ্ট ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি বরাবর লেখা চিঠিতে তাঁরা রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটনের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছেন।
ঢাকার ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, “জাতিগত নিধন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধতুল্য একটি মানবিক বিপর্যয় মিয়ানমারে বিস্তৃতি লাভ করেছে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে, শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে।”
রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাকে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া ও কসোভোয় সংঘঠিত গণহত্যাগুলোর সঙ্গে তুলনা করেন তাঁরা।
বিবৃতিতে বলা হয়, “জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি এজেন্ডা হিসেবে সংকটটিকে উপস্থাপনের জন্য আমরা নিরাপত্তা পরিষদকে বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে জরুরি ভিত্তিতে মিয়ানমার পরিদর্শন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
বিদ্যমান সংকট সমাধানে নোবেলজয়ী অং সান সুচির ভূমিকারও সমালোচনা করেছেন বিবৃতিদাতারা।