রোহিঙ্গা নারীদের বর্ণনা: মিয়ানমার থেকে তাড়াতে হত্যা-ধর্ষণ চালিয়েছে আরাকান আর্মি
2025.02.06
কক্সবাজার ও ঢাকা

রাখাইনের মংডু জেলার নয়াপাড়া সংলগ্ন গ্রামের নুরুন্নেসা (ছদ্মনাম) গত এক বছরে বোমা ও গুলির শব্দের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কখনো ভাবেননি আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলা এই সংঘাত একদিন তাঁর ঘরের দুয়ারে এসে পৌঁছাবে।
“যদিও মাঝে মাঝে দু’পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে আমাদের গ্রামকে পড়তে হয়েছে, কিন্তু কখনো ভাবিনি এ সংঘাতের বলি আমরা হব,” বেনারকে বলেন নুরুন্নেসা।
বেনারনিউজকে নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ জানালেও নিরাপত্তাজনিত কারণে নুরুন্নেসা তাঁর আসল পরিচয় প্রকাশে অনীহা জানান। একই কারণে তিনি কোনো ছবি তুলতেও রাজি হননি।
গত আগস্টের এক সকালে তাঁর ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে তিনি দরজা খুলে দেন জানিয়ে নুরুন্নেসা বলেন, “সাথে সাথে একদল আরাকান আর্মির সদস্য আমাকে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।”
আরাকান আর্মি তাঁর শ্বশুর ও দুই দেবরকে ধরে উঠানে নিয়ে “জবাই করার আগে” তাঁর ওপর “শারীরিক নির্যাতন চালায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্যাতনের সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে দেখি পুরো গ্রাম পুড়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। কোথাও কোথাও তখনও ছাইচাপা আগুন জ্বলছিল।”
ওই দিনের বর্বরতা থেকে তাঁর স্বামী কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচেন বলে জানান তিনি। এর বাইরে যারা জীবিত ছিল “তাদের মধ্যে অনেকে আহত ও মুমূর্ষু।”
জ্ঞান ফেরার পর অন্যদের সাথে তিনিও জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যান। “টানা তিন দিন এভাবে বন-পাহাড়, কর্দমাক্ত পথ ও বহু জলাশয় ও নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ এসে পৌঁছাই,” বলেন নুরুন্নেসা।
বাংলাদেশে আসার পথে জলাশয় ও বনের ধারে অনেক মৃতদেহ দেখেছেন বলেও বেনারকে জানান তিনি। বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবিরে নিজের স্বামীকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন বলে জানান।

দেশ ছাড়া করতে ধর্ষণ ও নির্যাতন
কক্সবাজারের জাদিমোড়া ক্যাম্পে সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আশ্রয় নেয়া আরেকজন মোছাম্মৎ বিবি হাওয়া (ছদ্মনাম)।
“এক বছর আগে আরাকান আর্মি আমাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে মংডুর এক স্কুলের অস্থায়ী ক্যাম্পে রেখেছিল। একদিন তারা এসে সকল যুবতী নারীদের আলাদা করে নিয়ে চলে যায়। তাদের পরিবার অনেক চেষ্টা করলেও তাদের কোনো হদিস পায়নি”, বেনারনিউজকে বলেন বিবি হাওয়া।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গা নারী বলেন, “আমার স্বামী আমার সাথে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা করছিল। তাই ওই ঘটনার পরপরই আমরা পালিয়ে পাহাড়, জঙ্গল পার হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছি।”
বেনারনিউজ প্রতিনিধি সম্প্রতি রাখাইনের মংডুতে আরাকান আর্মির শারীরিক নির্যাতনের শিকার এমন দশ জন নারীর সাথে কথা বলেছেন, যারা ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
পঞ্চাশোর্ধ নারী আফলাতুন খাতুন এখনো স্পষ্ট স্মরণ করতে পারেন কীভাবে তাঁর গবাদিপশু ড্রোন হামলায় মারা গেছে।
“সেপ্টেম্বরে হঠাৎ মাথার উপরে ড্রোন ওড়ার শব্দ। দেখতে দেখতেই হঠাৎ বোমা পড়তে শুরু করল। বোমার আঘাতে গোয়ালঘরে থাকা ১৩ টি মহিষ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ড্রোনের বোমায় মারা গেছে পাড়ার অনেক প্রতিবেশী। সেদিনই আমি ঘর ছেড়ে রওনা দিই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে,” বলেন তিনি।
মংডুর সুদাপাড়ার বাসিন্দা মো. ইউনুস (৪০) আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারে। তিনি বেনারকে বলেন, “নভেম্বরের প্রথম দিকে আরাকান আর্মি আমাদের গ্রামে এসে সবাইকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে। আর কখনও যেন ফিরে না আসি সেটা নিয়েও হুঁশিয়ারি দেয়।”
“কিছুদিন পর তারা আবার এসে কোনো কথা ছাড়াই বাড়িঘরে একদিক থেকে আগুন দিয়ে অন্যদিক থেকে বেপরোয়া গুলি চালাতে থাকে। তখনই আমি আমার পরিবার নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। অনেক কষ্টে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে পৌঁছাই,” বলেন তিনি।

দুই দিক থেকে নির্যাতনের শিকার
সম্প্রতি কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ৩৮ মুসলিম এনজিওদের জোট যারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিতে বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে তাদের এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর আরাকান আর্মির যৌন নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে।
প্রতিবেদনটি বলছে, রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী-দুই তরফ থেকেই আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, একই গ্রামে বার্মিজদের ছেড়ে দিলেও রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয়েছে।
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সংঘাতের সময় রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগও করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে যে রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে এসেছে তারা খাদ্য ও আশ্রয় ছাড়া মানবেতর জীবনযাপন করছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলেছে, রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী-দুই দিক থেকে জাতিগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্ধারণের পর এখন বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ চলছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। নতুন রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহের জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকেও অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের আলাদা করে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা চিকিৎসার সকল আয়োজন করেছে।”
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর বেনারনিউজকে জানিয়েছে, “লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জীবন ও নিরাপত্তার ওপর হুমকিস্বরূপ।”
সংস্থাটি জানায়, শিবিরগুলোতে নতুন-পুরোনো সব শরণার্থীর জরুরি চিকিৎসা সহায়তার আওতায় মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তাও অন্তর্ভুক্ত।
ই-মেইলে বেনারের প্রশ্নের জবাবে বুধবার সংস্থাটির মুখপাত্র আরও জানান, “গত কয়েক মাসে আসা নতুন রোহিঙ্গারা বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে সীমিত জায়গার মধ্যেও আশ্রয় পেয়েছেন। নতুনদের আশ্রয় নিশ্চিত করার বিষয়ে ইউএনএইচসিআর তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।”