রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় ফেসবুকও দায়ী: অ্যামনেস্টি

আহম্মদ ফয়েজ
2022.09.29
ঢাকা
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় ফেসবুকও দায়ী: অ্যামনেস্টি ইয়াঙ্গুনে রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কফি আনান নেতৃত্বাধীন পরামর্শক কমিটির সংবাদ সম্মেলন নিজের ফোন থেকে ফেসবুক লাইভে প্রচার করছেন একজন সাংবাদিক। মিয়ানমারে ফেসবুকই সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ২৪ আগস্ট ২০১৭। [রয়টার্স]
[রয়টার্স]

আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২। ইস্টার্ন সময় সকাল ১০:৪৫

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত জাতিগত নিধন ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনে ফেসবুকের যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলে দাবি করেছে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই সম্পৃক্ততার জন্য ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটাকে অভিযুক্ত করা হয়।

অ্যামনেস্টির দাবি, “ফেসবুকের অ্যালগরিদম রোহিঙ্গা বিরোধী বিষয়বস্তুকে সক্রিয়ভাবে প্রসারিত করেছে। এটি সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ঘৃণা-উৎসাহ রোধ করার জন্য বেসামরিক নাগরিকদের এবং অ্যাক্টিভিস্টদের অনুরোধকে উপেক্ষা করেছে এবং এর দ্বারা প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হয়েছে।”

এ বিষয়ে মেটার পাবলিক পলিসি ফর ইমার্জিং মার্কেট বিষয়ক পরিচালক রাফায়েল ফ্রাঙ্কেল শুক্রবার ইমেইলে বেনারকে জানান, “মেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সংহতি প্রকাশ করে এবং রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তাতমাদাওকে দায়বদ্ধ রাখার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।”

মেটা মিয়ানমার সংক্রান্ত জাতিসংঘের তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায়, আইনানুগ তথ্য প্রকাশ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারে ফেসবুকের কার্যক্রম ২০১৮ সালের মানবাধিকার প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনের পরামর্শের আলোকে স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও সংগঠন এবং জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতামতের আলোকে পরিচালিত হয়।

অ্যামনেস্টি বলছে, রোহিঙ্গারা কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে, কিন্তু ফেসবুক পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রযুক্তি জায়ান্টের কাছে ‘ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ারও আহবান জানানো হয়েছে।

অনলাইনে ঘৃণাত্মক বক্তব্য এবং বিভ্রান্তি পরিচালনা করতে ফেসবুকের আপাতদৃষ্টিতে অক্ষমতা বিশ্বের অনেক দেশের জন্য একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছে অ্যামনেস্টি।

মানবাধিকার গোষ্ঠীটির দাবি, “মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী তাতমাদাও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর জন্য এবং ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রধানত মুসলিম সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ ও সামরিক অভিযানের জন্য জনসমর্থন জোগাড় করতে ফেসবুককে ব্যবহার করেছিল।”

পরবর্তীতে, পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের সাত লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

২০১৮ সালে জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন নির্ধারণ করেছে যে, ফেসবুক মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অপমান করার জন্য একটি ‘উপযোগী যন্ত্র’ ছিল যেখানে বেশিরভাগ ব্যবহারকারীর জন্য, ফেসবুক হলো ইন্টারনেট মাধ্যম।

এর কয়েক মাস পরে, মেটার ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না-এমনটি স্বীকার করে একটি মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

মেটা তখন থেকে বলেছে, এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠানটি আরও বার্মিজ-ভাষী কন্টেন্ট মডারেটর এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।

অ্যামনেস্টি ২০২১ সালে হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সেস হাউগেন দ্বারা প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ মেটা নথিগুলো বিশ্লেষণ করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন জনসাধারণের প্রতিবেদন এবং রোহিঙ্গা ও প্রাক্তন মেটা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, ফেসবুকের মূল কোম্পানিকে (যা তখন ফেসবুক ইন্টা. নামে পরিচিত ছিল) ২০১৭ সালের আগে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংসতায় অবদান রাখার বিষয়ে তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছিল। তারা সে সময়ে এই ধরনের সতর্কতা মানতে ব্যর্থ হয়েছিল।

প্রতিবেদনে একজন নামহীন প্রাক্তন মেটা কর্মচারীকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, যিনি এপ্রিল মাসে অ্যামনেস্টিকে বলেছিলেন, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি গ্লোবাল সাউথের লোকদের জীবনকে কম মনোযোগের যোগ্য বলে মনে করে।

বিভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে আচরণ করা হয়,” দাবি করে এই প্রাক্তন মেটা কর্মী বলেন, “আগামীকাল যদি মিয়ানমারে এক হাজার মানুষ মারা যায়, তবে ব্রিটেনে ১০ জন মারা যাওয়ার চেয়ে এটি কম গুরুত্ব পাবে।”

অ্যামনেস্টি বলেছে, অ্যালগরিদম ছাড়াও ফেসবুকের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যবহারকারীদের রোহিঙ্গা বিরোধী পোস্ট করতে উৎসাহিত করেছে।

মেটা রোহিঙ্গাদের ঘৃণা করে’

মেটাকে রোহিঙ্গাদের আইনি, চিকিৎসা ও মনস্তাত্ত্বিক যত্নে সহায়তা করার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এক মিলিয়ন ইউএস ডলার শিক্ষা প্রকল্পে তহবিল দেওয়ার জন্য মেটাকে আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।

বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী ২১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট সাওয়ায়েদুল্লাহ অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, “আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে আমরা ফেসবুক থেকে একটি প্রতিকার পাওয়ার যোগ্য। ফেসবুক আমাদের জীবনকে আগের মতো করে দিতে পারবে না। শুধু আমরা তা করতে পারি। কিন্তু এটা করার জন্য আমাদের যেটা দরকার তা হলো শিক্ষা।”

বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, “অত্যাচারের দিকে অগ্রসর হওয়া মাস ও বছরগুলোতে, ফেসবুকের অ্যালগরিদম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার ঝড়কে তীব্রতর করে তুলেছিল; যা বাস্তব সহিংসতায় অবদান রেখেছিল।”

তিনি বলেন, যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছিল, তখন মেটা তার ঘৃণা-সঞ্চালনকারী অ্যালগরিদম দিয়ে লাভবান হচ্ছিল।

ফেসবুকের ভূমিকা ছিল মিয়ানমারের পক্ষে

অ্যামনেস্টির বিবৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)'-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বেনারকে বলেন, “২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার প্রমাণ ফেসবুকে ছিল। কিন্তু ফেসবুক মিয়ানমার পক্ষ নিয়ে সব ডকুমেন্টগুলো সরিয়ে ফেলে। এটি এক ধরনের অপরাধ।”

তাঁর মতে, যদি রোহিঙ্গাদের গণহত্যাসহ জুলুম নির্যাতনের দলিলপত্রগুলো ফেসবুকে থাকত তাহলে বিচার পাওয়া অত্যন্ত সহজ হতো। ফেসবুক অপরাধীদের সমর্থন করেছে, তাই তারাও অপরাধী।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং বেনারকে বলেন, “ফেসবুকের কারণে ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা আরো বেশি হয়েছে।”

মিয়ানমার সেনাদের ফেসবুকে উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস দেয়ায় ঘটনা বড়ো আকার ধারণ করে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও ফেসবুক তা না করে উল্টা রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত দলিলপত্র সরিয়ে নেয়।”

প্রসঙ্গত গত ডিসেম্বরে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর পেছনে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যকে দায়ী করার পাশাপাশি সহিংস ও উস্কানিমূলক পোস্ট প্রত্যাহার করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে ফেসবুকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদালতে ওই দুটি দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পক্ষে একযোগে মামলা দায়ের করা হয়।

এসব মামলায় মোট ১৫ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।

আপডেট: প্রতিবেদনে মেটা/ফেসবুকের বক্তব্য সংযোজন করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

Shayon
2022-09-30 02:36

As a social media, Facebook's actions like this are undoubtedly reprehensible. Facebook could have played a positive role in solving the Rohingya problem. In fact, the Rohingya problem needs to be solved quickly to protect the world humanity.