টেকনাফ স্থলবন্দরে সহজলভ্য রোহিঙ্গা শ্রমিক, মজুরি কমেছে স্থানীয়দের
2024.12.04
কক্সবাজার
বছর কয়েক আগে টেকনাফ স্থলবন্দরে কাজ করতেন স্থানীয় বাসিন্দা নূর আমিন (৩৮) । তাঁর দৈনিক মজুরি ছিল এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
তবে ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা টেকনাফে আশ্রয় নেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। কম মজুরির রোহিঙ্গা শ্রমিকেরা জায়গা নিতে থাকে স্থানীয়দের।
মজুরি কমতে থাকায় পেশা বদলে নূর আমিন এখন চাঁদের গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পের বাইরে আসার অনুমতি নেই। তবু্ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন কৌশলে তাদের বের করে এনে স্থলবন্দরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করাচ্ছেন। কারণ, কম মজুরিতে তাদের দিয়ে বেশি কাজ করানো যায়।
এভাবে বন্দরে স্থানীয় শ্রমিকরা হয় পেশা পাল্টাচ্ছেন, নতুবা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
টেকনাফের একাধিক শিবির ও স্থলবন্দরে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বেনারনিউজের সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন চিত্র দেখা গেছে।
নূর আমিন বেনারনিউজকে বলেন, চার বছর বন্দরে কাজ করেছি। সেখানে (বন্দরে) ভারী কাজ হলেও মজুরি খুব কম। রোহিঙ্গাদের আসার আগে মজুরি পেতাম সর্বোচ্চ দেড় হাজার থেকে এক হাজার টাকা। তারা আাসার পর মজুরি নেমে এসেছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে।
“সেখানে (বন্দরে) এখন আর দেশীয় শ্রমিকরা কাজ করে না। কম মজুরি দিয়ে রোহিঙ্গাদের দিয়ে সেখান কাজ করায়,” বলেন তিনি।
স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপনা কমিটির আহবায়ক ও টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী গত ১৫ নভেম্বর বেনারকে বলেন, “কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের লাভের জন্য বাংলাদেশের শ্রমিকদের বঞ্চিত করে অল্প মজুরি দিয়ে রোহিঙ্গাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। কারা এর সাথে জড়িত সেটি বের করার চেষ্টা চলছে।”
বন্দরে রোহিঙ্গা শ্রমিকের বিষয়টি আমাদের নজরে আসায় আমরা শ্রমিকদের জন্য কার্ড ইস্যু করা পরিকল্পনা করছি। যাতে সেখানে শুধু বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করতে পারেন। এরপর আর রোহিঙ্গা শ্রমিকের কাজ করার সুযোগ থাকবে না,” যোগ করেন ইউএনও আদনান।
রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেওয়া ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
স্থলবন্দর ব্যবসায়ী মো. আবদুল্লাহ বেনারকে বলেন, একসময় শুধু স্থানীয় শ্রমিকরা স্থলবন্দরে কাজ করতেন। আওয়ামী ব্যবসায়ীরা বন্দরে রোহিঙ্গা শ্রমিক খাটানো শুরু করেছিল। সরকারে পতনের পর তারা পালিয়েছে। এখন শুধু দেশীয় শ্রমিক দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা থাকবে আমাদের।
লেদা রোহিঙ্গা শিবির থেকে তিন বছর ধরে নিয়মিত বন্দরে কাজ করতে আসা ৪২ বছর বয়সী মুহাম্মদ আকবর বলেন, অধিকাংশ ব্যবসায়ী এখন শুধু রোহিঙ্গাদের দিয়েই কাজ করায়।
“ক্যাম্প থেকে আমরা প্রতিদিন যাওয়া-আসা করি। কেউ বাধা দেয় না,” যোগ করেন তিনি।
বেতন কম, মৃত্যুর ঝুঁকি
কম মজুরিতে কোনও ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী শ্রমিকরা।
শরণার্থী শ্রমিক সৈয়দ আলম বেনারকে বলেন, “আমার দুই বন্ধু (ট্রলার থেকে) কাঠ নামানোর সময় মারা গেছেন। দিল মোহাম্মদ নামে আরেক বন্ধু পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন।”
প্রায় তিন বছর আগে একইভাবে কাঠচাপায় মারা যান লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা করিম উল্লাহ। ৪০ বছর বয়সে নিহত করিমের স্ত্রী দলা বানু বেনারকে বলেন, “পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার স্বামী। তিনি মারা যাওয়ার পর চার সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে জীবন কাটাচ্ছি।”
বন্দরে কাজ করতে গিয়ে চলাচলের সক্ষমতা হারিয়েছেন একই ক্যাম্পের বাসিন্দা আমান উল্লাহ (৪৫)।
“কাঠ নামানোর সময় হঠাৎ তা আমার শরীরের ওপর পড়লে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আর চলাচল করতে পারছি না,” বেনারকে বলছিলেন তিনি।
লেদা শিবির উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “গত সাত-আট বছরে শুধু আমার ক্যাম্পের ১৬-১৭ জন কাঠ খালাস করার সময় মারা গেছেন। আরো ১৫-২০ জন হাত বা পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন।”
রোহিঙ্গাদের দাবি, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত স্থলবন্দরে ৩০ জনের বেশি মারা গেছেন। বন্দরে কাজ করার সময় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গার অঙ্গহানি হয়েছে। স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষ হতাহতের সংখ্যা সংরক্ষণ করে না।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছে। তবে স্থলবন্দরে তাদের সংখ্যা বেশি।
বন্দরের কাজে রোহিঙ্গা শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বৈঠক করেছে জানিয়ে বেনারকে তিনি বলেন, “দেশীয় শ্রমিকরা যাতে দিনমজুরির কাজে উৎসাহিত হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে কাজ চলছে। ”
ক্ষতিপূরণ মেলে না
লেদা শিবিরের শরণার্থীদের নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, নিহত বা আহত হলে কোনো নিয়োগকারী সেই রোহিঙ্গা বা তাদের পরিবারের খোঁজ রাখে না।
“আমি পঙ্গু হওয়ার পর, তারা (নিয়োগকারী) চিকিৎসার জন্য মাত্র পাচঁ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর কেউ খোঁজ নেয়নি। এখন আমার খুব কষ্টের জীবন পার করছি। চিকিৎসা করানোর টাকাও নেই,” বলছিলেন বন্দরে চার বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করা আমান উল্লাহ।
রোহিঙ্গা নারী দলা বানু জানান, তার স্বামী করিম উল্লাহ বন্দরে নিহত হলেও কেউ কোনো সহায়তা করেনি।
গত ১৪ নভেম্বর সরেজমিন স্থলবন্দরে দেখা যায়, কয়েকশ রোহিঙ্গা শ্রমিক বন্দরে মিয়ানমার থেকে আসা জাহাজ থেকে মালামাল নামাচ্ছেন। চারটি জেটি থেকে যে, যার মতো বিভিন্ন পণ্য খালাসে ব্যস্ত।
স্থলবন্দরে আট বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রোহিঙ্গা শ্রমিক কোরবান আলী বেনারকে বলেন, “সরকারের কাছ থেকে রেশন পেলেও তা দিয়ে আমাদের পরিবার চালাতে খুব কষ্ট হয়। তাই আমরা বন্দরে এসে কাজ করছি। বেতন কম হলেও টাকার প্রয়োজনে আমাদের এখানে (বন্দরে) কাজ না করে উপায় নেই। তাছাড়া এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তেমন ঝামেলা করে না। ”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফের সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী বেনারকে বলেন, “স্থলবন্দরে প্রভাবশালীর একটি দল দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের টাকা লুটপাট করতে স্থানীয়দের বদলে রোহিঙ্গাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশীয় শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে।”
“এটা সত্য যে, রোহিঙ্গারা অভাব ও বেকারত্বের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বন্দরে অবৈধভাবে কাজ করছে। তবে এটি বন্ধ করা দরকার,” বলেন তিনি।